বুধবার, জুলাই ৯Dedicate To Right News
Shadow

স্টারলিংক নিয়ে এতো হইচই কেন?

Spread the love

স্টারলিংক মূলত মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স পরিচালিত একটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট প্রকল্প। এর পেছনে রয়েছেন প্রযুক্তি দুনিয়ার আলোচিত উদ্যোক্তা এলন মাস্ক। লক্ষ্য একটাই: পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে, যেখানে প্রচলিত ব্রডব্যান্ড পৌঁছায় না, সেখানেও নিরবিচ্ছিন্ন উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া।

২০২০ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে পরীক্ষামূলকভাবে এই সেবা চালু হয়, এবং ধীরে ধীরে এটি গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ৭০টিরও বেশি দেশে প্রায় ৩০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী স্টারলিংকের সংযোগ ব্যবহার করছেন। কৃষিজমিতে বসে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ, সমুদ্রে ভেসে থাকা জাহাজে লাইভ ট্র্যাকিং, বা আফ্রিকার কোনো স্কুলে অনলাইনে পাঠদান—এসবই এখন বাস্তবতা।

তবে প্রযুক্তি হিসেবে স্টারলিংক এতটা আলোচিত হওয়ার কারণ হলো এর ল্যাটেন্সি ও কভারেজ। প্রচলিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের তুলনায় এটি অনেক দ্রুত, এবং বিশ্বের প্রায় সব জায়গায় কাজ করে, কারণ এটি পৃথিবীপৃষ্ঠের নিচু কক্ষপথে (Low Earth Orbit) অবস্থিত হাজারো ছোট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশে স্টারলিংক:

২০২৪ সালে বাংলাদেশ সরকার স্টারলিংককে দেশের বাজারে বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি দেয়। এটি এমন এক সময়ে ঘটে, যখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য উন্নত ডিজিটাল সংযোগ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে প্রশ্ন হলো—দেশে যখন গ্রামীণ এলাকাতেও ৪জি মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে, তখন স্টারলিংক আদৌ কতটা প্রয়োজনীয়? এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দেখতে হবে বাস্তব পরিস্থিতি।

যেসব জায়গায় মোবাইল টাওয়ার নেই, বিদ্যুৎ অনিয়মিত, বা আবহাওয়ার কারণে সংযোগ বিঘ্নিত হয়, সেখানে ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল ইন্টারনেট কার্যত অকার্যকর। স্টারলিংক এমন সব জায়গায়, যেখানে তার বা টাওয়ারের প্রয়োজন হয় না, শুধুমাত্র আকাশ উন্মুক্ত থাকলেই কাজ করে।

লাভ কি এই নেটওয়ার্কে থেকে?

স্টারলিংকের মূল শক্তি হলো এর সীমানাহীনতা। এটি কোনো অপটিক্যাল ফাইবার, মোবাইল টাওয়ার বা ভূ-ভিত্তিক ইন্টারনেট অবকাঠামোর ওপর নির্ভর করে না। এর মাধ্যমে এমন সব জায়গায় ইন্টারনেট পৌঁছানো সম্ভব, যেখানে এখনো বিদ্যুৎ এলেও ইন্টারনেট যায়নি। আর এখানেই এটি প্রচলিত ইন্টারনেট পরিষেবার তুলনায় ভিন্ন ও কার্যকর।

✅ ১. গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল বিপ্লব

বাংলাদেশের প্রায় ৩৫% মানুষ এখনো গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে, যেখানে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড কার্যত অনুপস্থিত।
স্টারলিংকের সাহায্যে—

# চরের স্কুলে অনলাইন ক্লাস চালু হতে পারে
# হাসপাতালবিহীন এলাকায় টেলিমেডিসিন কার্যকরভাবে চালানো সম্ভব
# স্থানীয় কৃষকদের জন্য বাজারদর, আবহাওয়ার আপডেট এবং আধুনিক কৃষি তথ্য সরাসরি মোবাইলে পাওয়া সহজ হবে
# রোহিঙ্গা ক্যাম্প বা সীমান্ত এলাকায় রিলিফ ও উন্নয়ন সংস্থা নিরবিচ্ছিন্নভাবে যোগাযোগ রাখতে পারবে

✅ ২. শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী সম্ভাবনা

গ্রাম-শহরের শিক্ষার ব্যবধান কমাতে ইন্টারনেট একটি বড় অস্ত্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো বহু গ্রামীণ স্কুলে নেই কোনো নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ।
স্টারলিংক সেখানে এনে দিতে পারে—

# প্রত্যন্ত স্কুলে স্মার্ট ক্লাসরুমের ভিত্তি
# শিক্ষার্থীরা ইউটিউব, ক্যান একাডেমি, কোরসেরা-র মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেরাই শেখার সুযোগ পাবে
# শিক্ষকরা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণে লাইভ অংশগ্রহণ করতে পারবেন
# পাবলিক পরীক্ষার অনলাইন প্রস্তুতির সমান সুযোগ তৈরি হবে

✅ ৩. স্বাস্থ্যসেবা সহজ ও দ্রুত হবে

# ভিডিও কনসালটেশনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া যাবে
# রিমোট মনিটরিং, যেমন ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার বা হার্ট রেট ডিভাইস, কাজ করবে দ্রুত সংযোগে
# সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলো যেমন ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ আরও কার্যকর হবে

✅ ৪. ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং ও উদ্যোক্তা কার্যক্রমে গতি আনবে

বর্তমানে গ্রামীণ তরুণদের অনেকেই ডিজিটাল মার্কেটিং, ডিজাইনিং, ইউটিউব, ড্রপশিপিংয়ের মতো কাজে আগ্রহী, কিন্তু ভালো ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে।
স্টারলিংক দিলে তারা—

# ঘরে বসেই আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করতে পারবে
# ভিডিও এডিটিং, স্ট্রিমিং বা ভারী আপলোডের কাজ দ্রুত হবে
# গ্রামীণ নারীরা ঘরে বসে অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত হতে পারবেন

✅ ৫. দুর্যোগকালীন সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে মোবাইল টাওয়ার বা তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু স্টারলিংক নিজস্ব স্যাটেলাইট সংযোগের কারণে—

# দ্রুত উদ্ধারকাজ সমন্বয় করা সম্ভব
# জরুরি বার্তা ও নির্দেশনা দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও পৌঁছে দেওয়া যাবে
# এনজিও বা রেসকিউ টিমের রিয়েলটাইম ট্র্যাকিং ও যোগাযোগ নিশ্চিত হবে

📡 প্রচলিত ইন্টারনেট সার্ভিস বনাম স্টারলিংক

বাংলাদেশে বর্তমানে আমরা প্রধানত দু’রকম ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করি—একটি হচ্ছে অপটিক্যাল ফাইবার বা ব্রডব্যান্ড সংযোগ, আর অন্যটি মোবাইল নেটওয়ার্কভিত্তিক ৩জি/৪জি ইন্টারনেট। শহরাঞ্চলে এই দুটি সেবা অনেকটাই কার্যকর হলেও, গ্রামীণ বা দুর্গম অঞ্চলে এগুলোর সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট নির্ভর করে তারের সংযোগের উপর, যা বসাতে সময় ও অবকাঠামো লাগে। আবার মোবাইল ইন্টারনেট অনেক সময় জায়গাভেদে গতি হারায়, এবং নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে পারে না।

এই প্রেক্ষাপটে স্টারলিংক সম্পূর্ণ নতুন এক সমাধান নিয়ে এসেছে। এটি কোনো তার বা টাওয়ারের ওপর নির্ভর করে না। আকাশে ভেসে থাকা হাজারো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সরাসরি ব্যবহারকারীর বাড়ির ছাদে বসানো একটি ডিস অ্যাক্সেস পয়েন্টে সংযোগ পাঠায়। এর ফলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে—পর্বত, চর, দ্বীপ বা গভীর জঙ্গলেও—স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহার সম্ভব, শুধুমাত্র খোলা আকাশের নিচে থাকা শর্তে।

গতি ও স্থিতিশীলতার দিক থেকেও স্টারলিংক এগিয়ে। যেখানে প্রচলিত ইন্টারনেট সার্ভিসে ১০০–১৫০ Mbps গতি পাওয়া যায়, সেখানে স্টারলিংক ২০০–৩০০ Mbps পর্যন্ত দিতে পারে, অনেক সময় এর চেয়েও বেশি। সর্বোপরি, প্রচলিত মোবাইল বা ব্রডব্যান্ড সংযোগের ক্ষেত্রে ঝড়-বৃষ্টিতে, বিদ্যুৎ সমস্যায় বা সার্ভারে লোড পড়লে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু স্টারলিংক স্বাধীন স্যাটেলাইট সিগন্যাল ব্যবহার করায় আবহাওয়া প্রভাব ফেললেও পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয় না।

স্থাপনের দিক থেকেও বড় পার্থক্য রয়েছে। ফাইবার অপটিক সংযোগ আনতে একাধিক দিন, এমনকি সপ্তাহও লেগে যেতে পারে। মোবাইল ইন্টারনেট অনেক সময় জায়গাভেদে দুর্বল থাকে। অথচ স্টারলিংকের সেটআপ একদিনেই শেষ করা যায় এবং কোনো জটিলতা ছাড়াই ব্যবহার শুরু করা সম্ভব।

যদিও স্টারলিংকের খরচ কিছুটা বেশি, তবে এর গতি, কভারেজ, স্থিতিশীলতা এবং নিজস্বতার কারণে এটি প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ বলে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় প্রচলিত সংযোগ সম্ভব নয়, সেখানে এটি একমাত্র নির্ভরযোগ্য বিকল্প।

✨ সাধারণ গ্রাহকের সর্বোচ্চ বেনিফিট কীভাবে সম্ভব?

একজন সাধারণ ব্যবহারকারী চাইলে—

1. স্টারলিংকের মাধ্যমে ইউটিউব চ্যানেল, ফ্রিল্যান্সিং বা রিমোট জব শুরু করতে পারেন
2. সন্তানদের অনলাইন ক্লাস, রিসার্চ, ভার্চুয়াল লাইব্রেরি ব্যবহার সহজ হয়
3. ভিডিও কল, কনফারেন্স, অনলাইন ব্যবসা চালানো যায় স্থির সংযোগে
4. গ্রাম-শহর নির্বিশেষে পরিবারে সকলের জন্য একসাথে ইন্টারনেট ব্যবহার সম্ভব
5. কোনো লোডশেডিং বা দুর্যোগেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না—এটা একধরনের আত্মনির্ভরতা

কিভাবে নিজে থেকে স্টারলিংক সেট আপ করবেন?

স্টারলিংকের সাবস্ক্রিপশন নেওয়ার প্রক্রিয়া সাধারণ গ্রাহকদের জন্য বেশ সহজ ও স্বয়ংক্রিয়। নিচে ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াটি দেওয়া হলো, যেন বাংলাদেশ থেকে একজন সাধারণ ব্যবহারকারী নিজেই ঘরে বসে অর্ডার সম্পন্ন করতে পারেন:

✅ স্টারলিংকের সাবস্ক্রিপশন নেওয়ার ধাপসমূহ (বাংলাদেশ থেকে)

🔹 ধাপ ১: অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ

প্রথমে চলে যান Starlink-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে:
🔗 [https://www.starlink.com](https://www.starlink.com)

🔹 ধাপ ২: আপনার লোকেশন দিন

হোমপেজে গিয়ে আপনি উপরের দিকে একটি ইনপুট বক্স দেখতে পাবেন যেখানে লেখা থাকবে:
“Service Address” বা “Order now by entering your address”

# এখানে আপনি আপনার বর্তমান ঠিকানা (যেমন: “Dhaka, Bangladesh” বা আরও নির্দিষ্ট করে পোষ্টকোডসহ) লিখুন
# ঠিকানা দিলে Starlink আপনাকে জানাবে সে এলাকায় সেবা এখনই পাওয়া যাচ্ছে কি না

🔹 ধাপ ৩: অর্ডার প্রক্রিয়া শুরু করুন

যদি সেবা আপনার এলাকায় চালু থাকে (Bangladesh এখন Starlink-এর “Available” অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত), তাহলে আপনি নিচের ধাপগুলোতে যেতে পারবেন:

# এককালীন কিট ফি: প্রাথমিক হার্ডওয়্যার খরচ (Dish, Router, Cables ইত্যাদি) — বাংলাদেশে এটি বর্তমানে প্রায় ৪৭,০০০ টাকা

# মাসিক চার্জ: দুই ধরনের সাবস্ক্রিপশন প্ল্যান — প্রায় ৬,০০০ টাকা ও ৪,২০০ টাকা সমমূল্যের মাসিক ফি (প্যাকেজ ভেদে স্পিড ও অগ্রাধিকার ভিন্ন হতে পারে)

🔺 মূল্য ডলারে দেখানো হবে, তবে বাংলাদেশি কার্ড বা ডলার সাপোর্টেড পেমেন্ট মেথড দিয়ে পরিশোধ করা যাবে

🔹 ধাপ ৪: অ্যাকাউন্ট তৈরি ও পেমেন্ট

# একটি Starlink অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে (ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে)
# পেমেন্ট তথ্য (VISA/Mastercard বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক কার্ড) যুক্ত করে অগ্রিম পেমেন্ট দিন
# সফল পেমেন্টের পর আপনাকে একটি কনফার্মেশন ইমেইল দেওয়া হবে

🔹 ধাপ ৫: ডিভাইস ডেলিভারি ও ইনস্টলেশন

Starlink আপনার ঠিকানায় কিট পাঠিয়ে দেবে (পাঠানোর সময় ও কাস্টমস প্রসেসিং বাংলাদেশে কিছুটা সময় নিতে পারে)

কিটে থাকবে:
# Satellite Dish
# WiFi Router
# Mounting Tripod/Base
# Power Cables

আপনি চাইলে নিজেই এটি ইন্সটল করতে পারেন (Plug & Play), অথবা লোকাল টেকনিশিয়ান সহায়তা নিতে পারেন

🔹 স্টারলিংক অ্যাপ (ঐচ্ছিক কিন্তু সহায়ক)

ডিভাইস ও সংযোগ ব্যবস্থাপনা সহজ করতে আপনি Starlink App ব্যবহার করতে পারেন:

📱 [Android App – Google Play](https://play.google.com/store/apps/details…)
📱 [iOS App – Apple Store](https://apps.apple.com/us/app/starlink/id1538973627)

📝 মনে রাখুন:

# অর্ডার লিংক: [https://www.starlink.com](https://www.starlink.com)
# ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট মেথড (VISA/Mastercard) থাকা আবশ্যক
# এককালীন হার্ডওয়্যার খরচ + মাসিক চার্জ
# বাংলাদেশে এখন সার্ভিস “Available”
# ইনস্টলেশনের জন্য আলাদা লোক নিয়োগ না করলেও হবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *