বুধবার, জুলাই ৯Dedicate To Right News
Shadow

প্রতিরক্ষায় আধুনিকায়ন: বাংলাদেশের পথচলা

Spread the love
  • নূর ই সিয়াম উচ্চারণ

একটি দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শক্তি তার সামগ্রিক নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানো কেবল কৌশলগত প্রয়োজন নয়, বরং জাতীয় গর্ব ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক। তবে আমাদের বর্তমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশে পুরনো প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। বিশ্ব যখন পঞ্চম প্রজন্মের অস্ত্র ও প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের নিজেদের সক্ষমতা পর্যালোচনা করে আধুনিকায়নের পথে এগোনো জরুরি। এই লেখায় আমরা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তুলনা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে আলোচনা করব।

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা: বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী একত্রে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে। সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে প্রায় তিনশতাধিক প্রধান যুদ্ধ ট্যাঙ্ক, যেমন টাইপ-৫৯জি এবং এমবিটি-২০০০। এছাড়া রয়েছে বিটিআর-৮০ এবং ওটোকার কোবরার মতো সাঁজোয়া যান। আর্টিলারি ব্যবস্থায় নোরা বি-৫২ এবং টাইপ-৬৬ এর মতো অস্ত্র রয়েছে, যা আধুনিক হলেও সংখ্যায় সীমিত। নৌবাহিনী দুটি টাইপ-০৩৫জি সাবমেরিন, কয়েকটি ফ্রিগেট ও কর্ভেট নিয়ে কাজ করছে। বিমান বাহিনীতে এফ-৭বিজিআই এবং মিগ-২৯ এর মতো যুদ্ধবিমান রয়েছে, তবে এগুলো তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তির। আকাশ প্রতিরক্ষায় এফএম-৯০ এবং কিউডব্লিউ সিরিজের মিসাইল রয়েছে, কিন্তু উন্নত রাডার ও স্টেলথ প্রযুক্তির বিপক্ষে এগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ।

এই অস্ত্রভাণ্ডারের বেশিরভাগই ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ দশকের প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি। তৃতীয় প্রজন্মের এই অস্ত্রগুলো গতি, সীমিত সেন্সর এবং হিট-সিকিং মিসাইলের উপর নির্ভরশীল। তুলনায় পঞ্চম প্রজন্মের অস্ত্র, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-২২ র‍্যাপ্টর বা চীনের চেংদু জে-২০, স্টেলথ প্রযুক্তি, উন্নত সেন্সর ফিউশন, সুপারক্রুজ ক্ষমতা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে তৈরি। এগুলো দূরপাল্লার যুদ্ধে শত্রুকে অজান্তেই আঘাত করতে সক্ষম। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আঞ্চলিক হুমকি মোকাবিলায় কিছুটা কার্যকর হলেও, বিশ্বের শীর্ষ সামরিক শক্তির তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে।

তৃতীয় বনাম পঞ্চম প্রজন্ম: প্রযুক্তির ব্যবধান
তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বা ট্যাঙ্কগুলো মূলত দৃশ্যমান পরিসরে যুদ্ধ করার জন্য ডিজাইন করা। এগুলোর রাডার এড়ানোর ক্ষমতা নেই, সেন্সর ফিউশন সীমিত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রাথমিক। অন্যদিকে, পঞ্চম প্রজন্মের অস্ত্রগুলো রাডারে প্রায় অদৃশ্য, উন্নত ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থা এবং নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক যুদ্ধ কৌশলের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, এফ-৩৫ লাইটনিং II রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা এত কম যে এটি শত্রুকে অগ্রিম সতর্কতা ছাড়াই আক্রমণ করতে পারে। এর সুপারক্রুজ ক্ষমতা এটিকে অতিরিক্ত জ্বালানি ছাড়াই অতিশব্দ গতিতে চলতে সক্ষম করে। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পাইলটরা দ্রুত ও নিখুঁত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পঞ্চম প্রজন্মের ট্যাঙ্ক, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের এম১এ২ আব্রামস এসইপি ভি৩ বা ইসরায়েলের মেরকাভা মার্ক ৪, অ্যাক্টিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে আগত ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে। এগুলোর কম্পোজিট আর্মার এবং নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক যুদ্ধ ক্ষমতা যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সুবিধা দেয়। তুলনায়, আমাদের টাইপ-৫৯জি ট্যাঙ্কগুলো প্রাথমিক সুরক্ষা ও গতিশীলতার উপর নির্ভরশীল, যা আধুনিক যুদ্ধে পর্যাপ্ত নয়।

আকাশ প্রতিরক্ষা: জরুরি আধুনিকায়নের ক্ষেত্র
বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে দুর্বল। আমাদের এফএম-৯০ এবং ইগলার মতো অস্ত্র স্বল্পপাল্লার হুমকি মোকাবিলায় কিছুটা কার্যকর হলেও, হাইপারসনিক মিসাইল বা স্টেলথ যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে প্রায় অকেজো। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় চতুর্থ এবং পঞ্চম প্রজন্মের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জন করা জরুরি। চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি, যেমন চীনের এইচকিউ-৯, ইসরায়েল-ভারতের বারাক-৮ বা রাশিয়ার পানৎসির-এস১, মাল্টি-ট্র্যাক রাডার এবং মোবাইল লঞ্চারের মাধ্যমে ক্রুজ মিসাইল ও ড্রোন প্রতিরোধে কার্যকর।

দীর্ঘমেয়াদে পঞ্চম প্রজন্মের ব্যবস্থা, যেমন রাশিয়ার এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ, যুক্তরাষ্ট্রের থ্যাড বা ইসরায়েলের আয়রন ডোম, আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষাকে অভেদ্য করে তুলতে পারে। এস-৪০০ চারশ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম, যা আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা দেবে। এছাড়া মাল্টি-লেয়ারড প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে শীর্ষ স্তরে এস-৪০০, মধ্য স্তরে বারাক-৮ এবং নিম্ন স্তরে পানৎসির-এস১ কাজ করবে। মোবাইল রাডার এবং এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম যুক্ত করলে আমাদের প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা বাড়বে।

নৌশক্তি: সমুদ্রে প্রভুত্বের পথে
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন অপরিহার্য। বর্তমানে আমাদের নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন, কয়েকটি ফ্রিগেট এবং কর্ভেট রয়েছে। তবে স্টেলথ প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ, গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট এবং আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষম জাহাজের সংযোজন প্রয়োজন। মেরিটাইম প্যাট্রোল এয়ারক্রাফট এবং উপকূলীয় রাডার নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন সমুদ্রে নজরদারি বাড়াবে। এছাড়া ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনের সংখ্যা বাড়ানো এবং অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার প্রযুক্তি অর্জন জরুরি।

দেশীয় জাহাজ নির্মাণ সক্ষমতা বাড়াতে খুলনা শিপইয়ার্ড এবং চট্টগ্রামের কারখানাগুলো আধুনিকায়ন করতে হবে। চীন বা তুরস্কের সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তর চুক্তি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। সাইবার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রযুক্তি এবং সি৪আইএসআর (কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন, কম্পিউটার, ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেইল্যান্স অ্যান্ড রিকনেসান্স) ব্যবস্থা নৌবাহিনীকে আরও কার্যকর করবে। ভারত, চীন, তুরস্কের সঙ্গে যৌথ নৌ মহড়া এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আমাদের অভিজ্ঞতা ও কৌশল বাড়াবে।

করণীয়: আধুনিকায়নের রোডম্যাপ
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে কয়েকটি কৌশলগত পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, প্রযুক্তি আপগ্রেডে জোর দিতে হবে। পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, যেমন চীনের জে-৩১ বা তুরস্কের কান, দীর্ঘমেয়াদে অর্জন করা যেতে পারে। ড্রোন যুদ্ধে বিনিয়োগ, যেমন তুরস্কের বায়রাক্তার টিবি২, আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বাড়াবে। সেনাবাহিনীতে আধুনিক ট্যাঙ্ক, যেমন টি-৯০এমএস, এবং স্বচালিত আর্টিলারি সংযোজন প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, সাইবার যুদ্ধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। নিজস্ব সাইবার কমান্ড এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ইউনিট তৈরি করা জরুরি। তৃতীয়ত, আঞ্চলিক জোট গঠন, যেমন তুরস্ক, চীন, পাকিস্তানের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি, কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করবে। সর্বোপরি, প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানো এবং দেশীয় উৎপাদন সক্ষমতায় বিনিয়োগ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

শিক্ষা ও সচনতা: জাতীয় প্রতিরোধের ভিত্তি
প্রতিরক্ষা শুধু অস্ত্রের বিষয় নয়, এটি জাতির মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির প্রতিফলন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং ভাষা শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। ইংরেজি, আরবি, ম্যান্দারিন বা ফ্রেঞ্চের মতো ভাষা শেখা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখবে। প্রতিরক্ষা বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা এবং সরকারের প্রতি জনমত গঠন গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার
বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ নয়, শান্তি ও আত্মরক্ষাই মূল লক্ষ্য। তবে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা, শক্তিশালী নৌবাহিনী, উন্নত সেনাবাহিনী এবং সাইবার নিরাপত্তার সমন্বয়ে আমরা একটি সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ গড়তে পারি। প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু বেঁচে থাকবে না, বরং একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে নিজের অবস্থান জোরালো করবে।

লেখক: স্নাতক (শেষ বর্ষ), সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *