মনি পাহাড়ী
২০০১ সাল। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগরে অনার্স এর ছাত্রী। আমার বাড়ি রাঙ্গামাটি। সহজ যোগাযোগ ছিল না বাসার সাথে।। বাসায় তখন টিএন্ডটি ফোন ছিল।। আমাদের তখন অনেক টাকা পয়সা।। আমার একবছরের পড়াশোনার খরচ আব্বা জাহাঙ্গীরনগর অগ্রণী ব্যাংকে রেখেছিলেন।। কিন্তু ফুটানি দেখাতাম না কখনও।। আব্বা খুব সিম্পল মানুষ ছিলেন।। একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক।। প্রথম যখন স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমান নাম জেলা পরিষদ) গঠিত হয় তখন তার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।। গাছের ব্যবসা করতেন।। তার হতে বহু প্রতিথযশা বিজনেসম্যান এর জন্ম হয়েছে।। সবাই তাকে এক নামে চিনতো।। এতো টাকা ছিল আমাদের যে, নাটকের প্রপস হিসেবে কানের দুলও কিনতাম স্বর্ণের।। কিন্তু একবিন্দু অহংকার ছিল না বাবার মধ্যে।। আমাদেরকে সবকিছুতে প্রাধান্য দিতেন।। প্রাইভেট মেডিকেল ছেড়ে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করার বিষয়ে এককথায় রাজি হয়ে গেলেন।। সেই ছোটবেলায় বাড়ি তৈরি করার সময়ও বললেন কোন ধরণের বাড়ি তৈরি করবেন।। আমরা তিনভাইবোন খুব সাহিত্য ঘেঁষা ছোটবেলা থেকে।। বললাম টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনে ঘুমাতে চাই।। আব্বা তেমন করেই বাড়িটা করলেন।। স্বভাবতই আমাদের অহংকারী হয়ে উঠা হলোনা।। আর তাই অনেককিছু অনেকের নজরেও আসেনা।।
ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার আম্মা খুব মিস করতেন আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পারাটা।। তিনি মাঝে মাঝেই চলে যেতেন ভার্সিটির হলে।। সাভার যেয়ে বাজার করে আনতেন নানানকিছু।। বৈশাখে আমার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে পান্তা ইলিশ এর আয়োজন করতেন।। আমি খেতে পছন্দ করি বলে হলের খালাকে দায়িত্ব দিয়ে আসতেন আমার জন্য আলাদা করে রান্না করে দেবার।।
এরমধ্যে টিএন্ডটি ইনকামিং আউটগোয়িং ফোন আসলো।। আম্মা আমাকে ইস্টার্ন প্লাজা নিয়ে গিয়ে সিম আর সেট কিনে দিলেন।। তখন আমাদের ক্লাসে মাত্র দুইজনের হাতে মোবাইল।। ফরহাদ আর আমার।। যারা দেখলো তারা অবাক হয়ে গেলো।। গ্রাম থেকে (রাঙামাটি) যাওয়া একটা মেয়ের হাতে মোবাইল!! চাইলে ফুটানি করা যেত।। কিন্তু ভেতর থেকে আসলোনা।।
আমাদের হলে অনেকের বাড়িতে টিএন্ডটি ফোন ছিল।। তারা আমার নাম্বার দিয়ে রাখতো বাড়িতে।। নিয়মিত ফোন আসা শুরু হলো।। সবাইকে বিভিন্ন ব্লক থেকে ডেকে দিতে হতো।। কিন্তু তাদের ফোন করতে যেতে হতো বহুদূর ডেইরি ফার্ম গেইট এ।। ঠিক করলাম ফোন এর বিজনেস করবো।।ভাবামাত্রই কাজ।। রুমের দরজায় সাদা কাগজে লিখে দিলাম ফোন করা ও কল চার্জ বিষয়টা।।
সে যে কী পরিমাণ সাড়া আসলো সেটা বলে বোঝানে যাবে না আক্ষরিক অর্থেই।। আমি পড়ালেখার ব্যাপারে কখনও সিরিযাস না যদিও রেজাল্ট বরাবরই ভালো।। কিন্তু আমার রুমমেট শিখা চাকমা খুব সিরিয়াস ছিল।। সবকিছু গুছিয়ে করতে ভালোবাসতো।। সে বললো একটা খাতা কিনতে।। আলাদা করে হিসাব রাখার জন্য।। খাতায় দাগ টেনে দিলো যত্ন করে।।
সেই শুরু আমার উদ্যোক্তা জীবনের।। ২০০৩ সাল থেকে ঢাকায় “আরণ্যক নাট্যদল” এ কাজ করা শুরু করলাম।। নিয়মিত ঢাকা আসা যাওয়া শুরু হলো।। ফলে আরেকটা ফোন কেনা হলো বিজনেস এর টাকা দিয়ে।। একটা সাথে থাকতো আরেকটা রুমে।। শিখা পরম যত্নে আমার বিজনেস সামলাতো।। ২০০৩ সালে হল ছাড়লাম।। তখন সেই বিজনেসও ছাড়তে হলো।।
তবে যতোদিন ফোনের বিজনেস ছিল বাড়ি থেকে কোনো টাকা নিতে হয়নি আমাকে।। উদ্যোগের অর্থে সব করেছি।।