- অধ্যক্ষ ড.গোলসান আরা বেগম
বাঙালি সংস্কৃতি শীতের পিঠা,নবান্ন উৎসব,কে ঘিরে আবর্তিত হয়। একাল সেকালের চিন্তা, চেতনা, চাল-চলন, জীবন যাপনে রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। শহর ও গ্রামের জীবনের ভাঁজের বৈষম্য চেষ্টা করেও ঘুছানো যাবে না। কুয়াশার চাদর মাথায় নিয়ে কনকনে শীত এলে গ্রাম্য জীবন যাত্রার চেহারা যায় পাল্টে।
শীতের তীব্রতার প্রভাব গ্রামীণ জনপদে বয়ে আনে নানা উৎসব পর্ব, সৌন্দর্যের নান্দনিকতা। একদিকে ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনির বিচ্ছেদ হাহাকার। অন্যদিকে ঝিলে বিলে অতিথি পাখির নয়নকাড়া মিলন মেলা। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো মাঠে বিছানো সবুজের কারুকার্যতা।
দুর্বা ঘাসের উপর শিশিরকণা টুপটাপ পড়ে। কাঁচা রোদ সকালে মুক্তা দানার মতো হাসে, শিশির বিন্দু বনবনানীর লতা পাতায়। সকালে বা সন্ধ্যায় আগুনের চার পাশে ঘিরে গা গরম করে শীতার্ত মানুষ। মজার মজার তর্কে তুলে হাসি ঠাট্টার বিনিময়। এ দৃশ্য শহরের খাঁচায় পোষা শিশুরা আদৌ কি দেখতে পারে, কেই বা জানে?
সন্ধ্যায় মা জননী কাঁপতে কাঁপতে মাটির চুলায় সেদ্ধ করে রাতের খাবার। তার আদরের সন্তানেরা আচল তলে বসে শীতের পিঠা খায় আর হিম ঠান্ডার মজা উপভোগ করে। যাদের লেপ-কম্বল নাই, থাকে কুঁড়ে ঘরে, তারা জানে শীতের তীব্রতা কত কষ্টের। তারপরও লবণ লংকার জীবন ভালোবেসে পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় ও শিরশিরে বাতাসে বসে পিঠে রোদ শুকায়। মাটির গতরে চাষাবাদ করে পেটের আহার, সোনালি ফসল ফলায়।
খেজুর গাছের গা থেকে নিঃসৃত তরল পদার্থ বিশেষ উপায়ে সংগ্রহ করা হয়, যাকে বলে খেজুরের রস। তা দিয়ে তৈরি করে খেজুরে গুড় ও ঘন রস, এই তথ্যটি শহরের বহু শিশুরা জানেও না। এই উপাদান দিয়ে তৈরি পায়েশ, মিষ্টান্ন, ভাঁপা ও পিঠাপুলি কতই না মজার, গ্রামে বসবাসকারীরাই কেবল তা জানে। কৃত্তিম উপায়ে তৈরি কেক খায় যারা, তারা কি করে বুঝবে শীতের পিঠার স্বাদ ও মজা কত!
শহরের অলি গলিতে আজকাল পিঠাঘরে পাওয়া যায় নানা ধরনের মজাদার হোম মেইড পিঠা। কেউ ইচ্ছে করলে স্বাদ নিতে পারে এসব ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি করা পিঠার। নবান্ন উৎসব মানেই বাহারি পিঠার মেলা। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে উদযাপন করা হয় রকমারী উপায়ে তৈরি পিঠা নিয়ে উৎসবের। শহরের পরিবারগুলো দুধকুলি, রসে ভেজানো পিঠা, পাটিসাপটা, চিতইপিঠা, নকশি পিঠা, কলাপিঠা সহ গ্রাম বাংলার উপভোগ্য পিঠা তৈরি করতে পারে না বা পেরেশানি হয়ে তৈরি করতে চায় না। ফলে দোকানের তৈরি পিঠাই তাদের কাছে অতি প্রিয় ও আকর্ষনীয়।
কেউ যদি শীতের আচল ছুঁয়ে জোনাকের খেলা, শিউলি তলায় মৌ মৌ সুবাসের গন্ধ, নবান্নের ঘ্রান, কাশফুলের দোল, ঝলমলে চাঁদের আলোর নৃত্য, মাঠে ঘাটে বিছানো সরিষার হলুদ বর্ণালী ঢেউ, কারুকার্য আকা সবুজ লাবণ্য দেখতে চায়, ছুটে যেতে হবে গাঁয়ে। আহারে সেই দিনগুলো আমি ফেলে এসেছি ঝাউতলায়, নদীর ধারে, পথের বাঁকে বাঁকে, বৃষ্টি ভেজা পিছল পথের কাদা জলে। স্মৃতির পাতা উল্টাই রোমন্থন করি মধুরতা ইট পাথরের শহরের বদ্ধ ঘরে বসে জীবনের শেষ বিকেলে।
সন্ধ্যায় মানুষের ঢল নামে চায়ের আসরে, গ্রামের বাজারের খুপরি দোকান ঘরে। ধোঁয়া ওড়ানো চায়ের কাপে উল্টায় রাজনীতির পাঠ, নানা কথার ফুল ঝুড়ি। গাল গপ্পের ফাঁকে রাতের গভীরতা কখন নেমে আসে তা বুঝতেই পারে না কেউ। সর্বক্ষণ বিদ্যুত সেবা পেয়ে আড্ডাগুলো জমে উঠে বেশ। এই তো গ্রামীণ জীবনে শীতের তীব্রতা মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকার মধুরতা।
কে কোথায় আছো,ক্ষণিকের তরে গাঁয়ে ফিরে যাও। মাথায় পড়ে শীতের টুপি, ঘন কুয়াশায় পায়ে হেঁটে গাঁয়ের পথে পথে ঘুরে বেড়াও। পাবে এক অনাবিল শান্তি, সহজ সরল গাঁয়ে বসবাসকারি মানুষের নরম আদুরে সুখানুভূতি। এ ঘরে ও ঘরে শীতের পিঠা খাওয়ার মজায় অন্য রকম মজার আমেজ খুঁজে পাবে। যে যেখানে যায় যাক সুখের খোঁজে, আমি এখানেই গাঁয়ের পখে হেঁটে বেঁচে থাকবো হাজারো বছর।
লেখকঃ অধ্যক্ষ ড.গোলসান আরা বেগম, কবি ও লেখক এবং উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ কৃষকলীগ।