শুক্রবার, মার্চ ২৯Dedicate To Right News
Shadow

হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্ররা

Spread the love
  • শফিকুর রহমান শান্তনু

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে এক ফুটপাতের বই বিক্রেতা হাসিমুখে বলেছিল, স্যার চলে না গিয়ে আমি মরে গেলে কি হতো! আমি মরে যেতাম!

কি অসম্ভব কথা! কি হয় ও হুমায়ূন আহমেদের? রাজা তো তার ছেলের জন্য জীবন বাজি রাখতে চেয়েছিল। এই রাস্তার পাশের লোকটার জন্য কি এমন করেছেন হুমায়ূন আহমেদ? তার যখন এসিডিটির ব্যথায় পেট ফেটে যেতে চায় হুমায়ূন আহমেদ কি একবারও তার পিঠে হাত রেখেছে? তার ওষুধ কেনার জন্য বিশটা টাকা ধার দিয়েছে? এক বেলা তাকে পাশে বসিয়ে গরম ভাত কই মাছের ঝোল দিয়ে খেতে দিয়েছে? তাহলে কেন এই ধান্ধাবাজির দেশে একজন সামান্য বই বিক্রেতা তার জীবনের বিনিময়ে একজন লেখকের জীবন চাইবে? আর কোনকালে কোন ভাষার লেখকের জন্য এমন অপরিসীম ভালবাসা কেউ দেখিয়েছে বলে আমার জানা নাই।

কয়েক বছর আগে রাহাত জামিলের সম্পাদনায় ‘হুমায়ূনের ভুবন’ নামে একটি স্মারক গ্রন্থ বেরোয়। সম্পাদকের অনুরোধ ছিল, তাঁর নাটকের বিচিত্র চরিত্রের ওপর লিখতে। আমি নিয়মিত নাটক লিখি বলেই হয়তো আমার জন্য এই শাস্তির সুব্যবস্থা। আমি বড় হয়েছি হুমায়ূন আহমেদের সময়ে। তাই তার রচিত যেকোন লেখা সম্পর্কে লিখতে গেলে নির্মোহভাবে আমার পক্ষে লেখা সম্ভব না। তাছাড়া আমি গবেষক নই। হতেও চাই না। তবে হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা আমার মতো হাজারো মানুষকে কেন ও কিভাবে পৃথিবীকে দেখার চোখ তৈরি করে দিয়েছিল, সে সম্পর্কে আধলাইন লেখা যেতেই পারে।

চরিত্রের সংগা দিতে গিয়ে এরিস্টটল বলেছেন – by character, i mean that in virtue of which we ascribe certain qualities to the agents – যে যে ধর্ম থাকায় ব্যক্তিতে দোষগুন আরোপিত হয়, চরিত্র বলতে সেই ধর্মকেই বোঝায়। এই ধর্মই এক ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তি থেকে স্বতন্ত্র করে রাখে এবং এই ধর্ম থেকেই সমস্ত আচরণ বা কর্ম জন্মায় ও তার দ্বারাই কর্ম বিশিষ্টতা পায়। নাট্যসাহিত্যে ‘ভালো চরিত্র’ কথাটার দুটি অর্থ। প্রথমত : নৈতিক উদ্দেশ্যের দিক থেকে ভালো। দ্বিতীয়ত: মনস্তাত্বিক অভিব্যক্তির দিক দিয়ে ভালো। যুধিষ্ঠির যে অর্থে ভালো দুর্যোধন সেই অর্থে ভালো না হলেও সুন্দর শয়তান হিসেবে ভালো চরিত্র হতে পারে। তাই এরিস্টটলের মতে ভালো চরিত্রের ভালোত্ব –

ক) নৈতিক আদর্শ (it must be good)

খ) ঔচিত্য (propriety)

গ) বাস্তবতা (true to life)

ঘ) সঙ্গতি (consistency)

এছাড়াও চরিত্রের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত: সরলতা ও জটিলতা আর দ্বিতীয়ত: গভীরতা ও অগভীরতা। অর্থাৎ চরিত্র যেমন নৈতিক আদর্শের দিক দিয়ে উচিত বা অনুচিত, ভালো বা মন্দ, বাস্তব বা অবাস্তব, সঙ্গত বা অসঙ্গত হতে পারে তেমনি ভাবদ্বন্দ্বের বৈচিত্রের দিক থেকে সরল বা জটিল , গভীরতার দিক দিয়ে অগভীর বা গভীর হতে পারে।

এই হচ্ছে মোটা দাগে চরিত্রের তাত্বিক কথা। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের কালজয়ী চরিত্ররা এইসব বৈশিষ্ট্যপূর্ন বলেই আজো আমাদের হৃদয়ে অম্লান হয়ে হয়ে আছে। সেই বাকের ভাই, মুনা, সোবহান সাহেব, নান্দাইলের ইউনুস, মনা ডাকাত, আনিস, কংকা, রূপা এদের মায়া থেকে আমরা কোনদিন হয়তো বোরোতে পারবো না। হুমায়ূনের আসল কৃতিত্ব আমার কাছে এটা মনে হয় না। কমবেশি প্রত্যেক সফল নাট্যকারেরই এমন কিছু স্মরনীয় চরিত্র থাকে। হুমায়ূনের মুনশিয়ানা হচ্ছে, তাঁর নাটকে প্রত্যেকটি চরিত্রই স্বয়ংসম্পূর্ন। তাদের অন্তত একটি করে ধর্ম থাকে যা দিয়ে তাদের বিশিষ্টতা প্রকাশ পায়। অন্য চরিত্র থেকে তাকে আলাদা করা যায়। এমুহূর্ত্তে স্মৃতি থেকে একটা নাটকের কথা বলছি – মাটির পিনজিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে। সম্ভবত ১৯৯৩ সালে বিটিভিতে নাটকটি প্রথম প্রচার হয়। প্রযোজনা করেন নওয়াজীশ আলী খান। গ্রামে এক ভাড়াটে খুনির আগমন দিয়ে গল্পের শুরু। সেই খুনির নাম ইউনুস। ইউনুসের ভাষায় নান্দাইলের ইউনুস। এনাটকে ইউনুস ছাড়াও আরো ৭ টি চরিত্র দেখতে পাই। মাস্টার, তালুকদার, তালুকদারের স্ত্রী, কুসুম, মজিদ, দোকানদার ও মরিয়ম। সবচেয়ে ছোট চরিত্র দোকানদারের। যতটুকু মনে পড়ে, মাত্র দুটো দৃশ্যে তার উপস্থিতি। অথচ এ দুটো দৃশ্যেই একজন গ্রাম্য কৌত‚হলী, সৎ ও আন্তরিক দোকানদারের চরিত্র চিত্রিত হতে দেখি যা আমাদের চিরায়ত গ্রামবাংলার দোকানদার পেশাজীবির প্রতিনিধিত্ব করে। গ্রামে কনকনে শীতের রাতে ইউনুস যখন আসে প্রথম দেখা হয় দোকানদারের সাথে। স্বাভাাবিক কৌত‚হলবশত নতুন লোক দেখে দোকানদার জিগ্যেস করে, ভাইজান, আপনার পরিচয়? শুধু তাই না! সে ইউনুসকে পরামর্শ দিয়ে বলে, শীতের রাতে পান খেলে কলিজা গরম হয়। ইউনুস তাকে একটা বড় নোট দিলে সে অকপটে জানায়, টাকার ভাংতি তার কাছে নেই। পরে আবার ইউনুসের সাথে দেখা হলে সে ভাংতি টাকা ইউনুসকে ফেরত দিতে চায়। এখান থেকে তার নৈতিক আদর্শের পরিচয় আমরা পাই। মাত্র দুটো দৃশ্যে আরোপিত কোন সংলাপের ব্যবহার ছাড়াই স্বাভাবিক কথপোকথনের মধ্য দিয়ে একজন দোকানদারের চরিত্র ফুটিয়ে তোলার যে অসামান্য নৈপুন্য হুমায়ূন দেখান, তা অতুলনীয়। গল্পের দুটো প্রধাণ চরিত্র তালুকদার ও তালুকদারের স্ত্রী। তালুকদার খারাপ চরিত্রের প্রতিভ‚। অন্যদিকে তার স্ত্রী বিপরীতধর্মী। কিন্তু তাদের চরিত্রদুটি সমান্তরালে যখন এগিয়ে চলে তখন রবীন্দ্রনাথের সেই চরণদুটি মনে পড়ে –

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।

তালুকদার মাষ্টারকে খুন করাবার জন্য ইউনুসকে ভাড়া করেছে। কিন্তু তালুকদারের স্ত্রী তা চায় না। এজন্য সে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে। ইউনুসকে ভাই ডেকে অনুরোধ করে খুন না করে চলে যাওয়ার জন্য। ইউনুস তাকে বলে, আমি চইলা গেলে কোন লাভ নাই বইন। আরেকজন আসবো। সে চইলা গেলে আসবো আরেকজন। আপনি ভাই ডাইকা কয়জনরে ফিরাইবেন? তার থেইকা যারে ফিরাইলে কাম হইবো তারে ফিরান। আপনার স্বামীরে ফিরান।

তালুকদারের স্ত্রী তাকে বলে, আপনের নিজের কোন বিবেক নাই?

ইউনুস বলে, না, নাই। বিবেক থাকলে এই কাম কেউ করে? করে না। আমি পিশাচ। মানুষ হইয়া জন্ম নিছিলাম। হইছি পিশাচ। মাঝেমইধ্যে রাইতে ঘুম হয় না। বইসা বইসা ভাবি, কে! কে আমারে পিশাচ বানাইল?

কিন্তু ইউনুসের মধ্যে যে অনুভুতিপ্রবণ মানবিক মন রয়েছে, তা আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন কর্মকান্ডে। বিশেষ করে মাষ্টারকে খুন করে আসার পরে তালুকদারের স্ত্রী যখন ইউনুসের গায়ে থুতু দেয় তখন ইউনুস মৃদু হেসে বলে, বইন, আপনারে তিনদিন সময় দিছিলাম। আপনে আপনের স্বামীরে ফিরাইতে পারেন নাই। আপনে মাস্টার সাহেবরে খবর দিতে পারতেন। দেন নাই। আপনে পুলিশের কাছে যাইতে পারতেন। যান নাই। বইন, আপনে আপনার নিজের গায়ে থুতু দ্যান। আপনার স্বামীর গায়ে দ্যান। আমি কেউ না। আমি কেউ না। আমি কেউ না, বইন।

তালুকদারের স্ত্রীর যা করনীয় তা সে না করে যখন স্বামীর হীনকর্মকে সে মেনে নিচ্ছে, সে যেন তার কাজকে পরোক্ষভাবে সমর্থনই করছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ইউনুস।

মাস্টার সাহেবের চরিত্রটি নিতান্ত পরোপকারী ভালো মানুষের। আরো দুটো অসামান্য চরিত্র বাড়ির কাজের লোক কুসুম ও মজিদের। কুসুম তালুকদারের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হলেও বাড়ির ফাইফরমাশ খাটে। তার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তালুকদার তার বিয়ের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে উদাসীন। তাই সে নিজেই অবিবাহিত কাউকে পেলে নিজের বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে। এই প্রসঙ্গ তোলার বিষয়টি খুব মজার। এমনভাবে বলে, যেন সে বলে নি। কিন্তু বলা হয়ে যায়। অর্থাৎ নিজের মনের কথা অন্যের নামে বানিয়ে বলে। তার এই স্বভাবের বিষয়টা ভালাভাবেই জানে তালুকদারের স্ত্রী। তাই সে বলে, বানায়া বানায়া এইসব কথা বলতে তোর শরম করে না?

কুসুম মাথা নুঁয়ে বলে, শরম করে মামি। খুব শরম করে। তারপরেও বলি। আমার বিয়া হওয়া খুব দরকার। রাইত হইলে মামা আমার দরজা ধাক্কায়। আমার বিবাহ হইলে আপনে বাঁচেন। আমিও বাঁচি।

এমন সরল স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে কুসুম চরিত্রের দুঃখবোধের যে গভীরতা নাট্যকার প্রকাশ করেন, তা যেন কেবল হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব। মাস্টার সাহেবের অনাথ নাতনি মরিয়মের বেলায়ও একথা সত্য। নির্মম সত্যকে সে গ্রহণ করেছে সাচ্ছন্দে, সহজভাবে। ইউনুসকে সে ধাঁধাঁর মতো করে জিগ্যেস করে, আচ্ছা, কনতো দেহি, আমার মা বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে?
নিষ্ঠুর ঠান্ডা মাথার খুনী ইউনুসও এইটুকু বাচ্চা মেয়ের এমন কথায় অপ্রস্তুত ও বিচলিত হয়ে বলে, উনি মারা গেছেন।

মরিয়ম তাকে অবাক করে দিয়ে শিশুসুলভ হেসে বলে, ধুরো ব্যাটা, উনি জীবিত আছেন। আমার বাবা মারা গেছেন। মায়ের আরেক জাগায় বিয়া হইছে। কবিতা শুনবেন?

মজিদ তালুকদারের অনুগত ভৃত্য। এই আনুগত্য তার ভেতরে এমনভাবে প্রোথিত যে, তালুকদার যা বলে, সেটাকেই ভালোমন্দ বিবেচনা না করে সে সত্য বলে মানে। তাই ইউনুস যখন তাকে মাস্টার সাহেবের সম্পর্কে জিগ্যেস করে, সে অবলীলায় বলে, ও আল্লা! মাস্টারসাহেবরে চিনবো না? সে কারো কাছে মন্দ। কারো কাছে ভালো। আমরার কাছে মন্দ।

একইসাথে চরিত্রের মধ্য দিয়ে দার্শনিক সত্যকে তুলে ধরেন নাট্যকার যা তাঁর চরিত্র নির্মাণের হাতিয়ার বলবো। তাই ইউনুসের মুখ দিয়ে তিনি বলান, জায়গা সবসময় সুন্দর। অসুন্দর হয় মানুষ।

গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ‘আন্তেগোনে’ তে একটি সংলাপ ছিল ‘সমস্ত বিস্ময়ের মধ্যে জগতে মানুষই সবচেয়ে বড় বিস্ময়।’ ইউনুসের মুখে ঐ সংলাপ যেন এই বিস্ময়কে আরেকবার জাগিয়ে তোলে। আমাদের ভাবিয়ে তোলে।

হুমায়ূন আহমেদের চরিত্র নির্মাণের আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে, তিনি কোন চরিত্রকেই একেবারে সাধু সন্ত কিংবা পুরোপুরি শয়তান হিসেবে বানান না। তারা আমাদের মতোই হাড়ে মাংসে মানুষ। তাই তাদেরকে দেখতে গিয়ে মনে হয়, তারা আমাদের চারপাশ থেকে উঠে আসা চরিত্র। হয়তো আমরা তাদেরকে সেভাবে নোটিশ করি না। কিন্তু হুমায়ূণ আহমেদ তাদেরকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে রূপদান করেন।

সাধারণত চরিত্রের দুরকম রূপ হয়ে থাকে। প্রকাশধর্মী ও বিকাশধর্মী। প্রকাশধর্মী রূপটি সেখানেই যেখানে চরিত্রে ধরাবাঁধা প্রবনতাই অপরিবর্তিতরূপে বারবার আবৃত্ত হয়, যেখানে চরিত্রে রূপ থাকে কিন্তু রূপান্তর থাকে না। এক কথায় বলা যায়, চরিত্র যেখানে একহারা সেখানেই তা প্রকাশধর্মী। আর যেখানে প্রবনতাসম্পন্ন চরিত্র , পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এগুতে এগুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, চরিত্রের মধ্যে গুনগত পরিবর্তন ঘটে, সেখানেই চরিত্র বিকাশধর্মী। এই যেমন বিকাশধর্মী চরিত্রের একরূপ, তেমনি আর একটি রূপও হতে পারে। যেখানে কোন বিশেষ চরিত্রে একাধিক ভাবদ্বন্দ্বের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং কখনো একটি , কখনো বা অন্যটি প্রধান হয়ে উঠে চরিত্রের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করতে থাকে, তথা চরিত্রটিকে জটিল ও ভাব-শবল করে তোলে, সেখানেও একধরনের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। হুমায়ূন আহমেদের চরিত্ররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এভাবেই প্রকাশধর্মী রূপ থেকে বিকাশধর্মী রূপে রূপান্তরিত হয়। শুধু তা না! তিনি তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই আমাদের সমাজের বিভিন্ন সামাজিক, অসামাজিক, মানবিক, অমানবিক, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সচেতনতামূলক ইস্যুগুলোকে সাবলীল ও আকর্ষনীয়ভাবে নিজস্বভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। এই নিজস্বভঙ্গি তৈরি করেছে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট। একদিনে কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি হয় না। ধীরে ধীরে তা গড়ে ওঠে। আমার মনে হয়, যে যত বড় নাট্যকার তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট তত বেশি দর্শক হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। তখন নাট্যকারের নাম না দেখেও চরিত্রের আচরণগত কার্যকলাপ দেখে বলে দেয়া যায়, এটা কে লিখেছেন। এদিক থেকে সফল হুমায়ূন।

তাত্বিক আলোচনা করবো না বলেও হয়তো কিছু তাত্বিক কথা ঢুকে পড়ল। শেষ করবো, এক ছোট্ট স্মতিচারণ করে। ২০০৮, ডিসেম্বর। আমাদের যাওয়ার কথা, সেন্ট মার্টিন। এই দ্বীপের অনেক নাম শুনেছি। তাই ঢাকা থেকে যখন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হই, তখন থেকেই জীবনে প্রথম সেন্ট মার্টিন যাবার আনন্দে আমরা উত্তেজিত। ঠিক আগের রাতে ছোট খালু জানালেন, ছোট একটা সমস্যা হয়েছে।

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি, কি সমস্যা?

আমাদের সাথে জাহাজের ভিআইপি কেবিনে আরেক পার্টি যাবে। সেই পার্টির যিনি মাথা তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ।

আমাদের ভাইবোনদের তো মাথা খারাপ অবস্থা! কোথায় সেন্ট মার্টিন! হুমায়ূন আহমেদকে সামনা সামনি দেখতে পাবো, এই আনন্দেই আমরা মহা উত্তেজিত। পরদিন খুব ভোরে আমরা কক্সবাজার থেকে টেকনাফের পথে যাচ্ছি। আগে পিছে কোন গাড়ি দেখলেই জানলা দিয়ে গলা বের করে বোঝার চেষ্টা করছি, ঐ গাড়িতেই হুমায়ূন আহমেদ আছেন কিনা! জাহাজে উঠেও এক ধরণের টেনশন। হুমায়ূন আহমেদের নাম গন্ধ নাই! তাহলে কি তিনি আসবেন না!

না, তিনি এলেন! ছোট খাট একটা মানুষ। কিন্তু তাকিয়ে দেখতে বসলে দেখা শেষ হয় না। আমার দুই খালা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন, আমাদের সাথেও এক লেখক আছে!

আমি তো লজ্জায় লাল নীল বেগুনি। তিনি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, আমি কি লিখেছি? কোথায় পড়ি? এসব। যাওয়ার সময় কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভালো থেকো লেখক।

সেদিন অনেক কথাই বলার ছিল তাঁকে। কিন্তু মুগ্ধতার রেশ কাটে নি বলে কিছুই বলা হয় নি। ফিরতি পথে বলেছিলাম, স্যার, আপনাকে তো আর পাবো না। তাই একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিন। আসলেই তাঁকে পাওয়া গেল না। আমি কখনোই কারো কাছে অটোগ্রাফ চাই নি। এও জানি, কখনোই আর কারো কাছে অটোগ্রাফ চাইব না। তিনি কত বড় সাহিত্যিক কিংবা নাট্যকার সে তুমুল বিতর্কে যাব না, শুধু একটা কথা গলার রগ ফুলিয়ে বলতে পারি, আমার অর্ধেক জীবন দখল করে ছিল যে মানুষটা, তিনি হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেখা পড়ে আমার প্রথম মনে হয়েছিল, আমারও কিছু বলার আছে। এমনটা আর কে পারবে!

আজও তিনি আলো করে রাখেন আমাদের বাড়ির বুক শেলফের সবচেয়ে উঁচু তাক। আজও হঠাৎ কোন মধ্য দুপুরে তাঁর কথা মনে হলে হাহাকার করে উঠি। নিজের অজান্তেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন এই বাংলার অগনিত পরিবারের ঘর পালানো ক্ষ্যাপা ছেলেটা। তাই তাঁর দম ফাটানো হাসির নাটক দেখতে বসলে এখণ অজান্তেই ভিজে ওঠে চোখ। বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে কিছু উঠে আসতে চায়। চোখে পোকা পড়েছে বলে চোখ মুছতে যাই না। কিছুৃ অশ্রু বড় পবিত্র। তাকে মুছতে নেই। মৃত্যু তার ক্ষমতা দেখিয়েছে, ভালবাসার ক্ষমতা কতোটুকু, স্বৈরাচারী মৃত্যু তা জানে না।

শফিকুর রহমান শান্তনু: লেখক ও নাট্যকার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *