বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২Dedicate To Right News
Shadow

গুলশান চৌধুরীর বড় গল্প “কবি”

Spread the love

সুতপাদের গ্রামে এক কবি এসেছে। কি যেন সব তথ্য উপাত্ত জানতে। বেশ কিছুদিন থাকবে। কবিকে পেয়ে গ্রামের সব শ্রেণী পেশার মানুষ অনেক আনন্দিত। শিক্ষিত, মার্জিত আধুনিক কবি। কবিও যার সাথেই দেখা হয় তার সাথেই সালাম বিনিময় করে। গ্রামের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে কি সব মানুষের কাছে থেকে জানে। সবাই তাকে সাহায্য করে।

সুতপার বান্ধবীর ভাইয়ের সাথে নাকি ইতোমধ্যেই অনেক ভাব জমে গেছে। ওর বান্ধবী দেখা হলেই শুধু কবির গল্প। করবেই বা না কেন, কবি তো ওদের বাড়িতেই উঠেছে। সুতপার বান্ধবী অনু কবির সব কথা সুতপাকে বলে। কি করে, কি খাবার পছন্দ করে, কয়টায় ঘুমায়, কখন ঘুম থেকে ওঠে ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সবেমাত্র পাশ করে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হয়েছে, লালন গবেষক।

অনুরা গ্রামের সব থেকে ধনী। বাইরে থেকে কেউ এলে ওদের বাড়িতেই সবাই থাকে। অতিথি থাকার জন্য একটা আলাদা বড় ঘরই আছে। বেশ কয়েকটা রুম। একসাথে বেশ কয়েকজন অতিথি এলেও সমস্যা হয় না। এখন আপাতত কবিই আছে। তাই অনুর মা-ই সব দেখভাল করেন। অনু মায়ের থেকেই সব জানে।

সুতপা সাধারণত খুব একটা বাইরে যায় না। সামনে ইন্টার পরীক্ষা। পড়ালেখার অনেক চাপ। কলেজও বন্ধ। শুধু প্রাইভেট পড়তে কলেজে যায়। অনু সব সময়ই সুতপার বাড়ি এসে ওকে ডেকে নিয়ে যায়। আজ যে কি হলো, সুতপা অনু আসার আগেই রেডি হয়ে ওদের বাড়ি যায়। ইচ্ছা ছিলো কবিকে একবার দেখার। এতো গল্প চারপাশে, ইচ্ছে তো হতেই পারে!

সুতপা গেটের কাছে যেতেই অনুর সাথে দেখা। অনু তো অবাক, সুতপাকে তাদের বাড়ি দেখে, হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। অনুর মা ভাইও চলে এসেছে। ওরা সবাই জোর করে সুতপাকে ভিতরে নিয়ে বসায়। সুতপার কেমন যেনো লাগে। কিন্তু অনুর মা সব স্বাভাবিক করে দেন। সুতপার পড়ার খবর জানতে চান, মা-বাবার খবর নেন। তারপর নাস্তা খেতে দেন। সুতপা কোনোমতে একটু খেয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেড় হয়।

কিন্তু কোথাও কবিকে সে দেখতে পেলো না। অবশেষে কৌশলে জিজ্ঞেস করে অনুর বাবার কথা। অনু বলে তার বাবা কবিকে নিয়ে খুব ভোরে অন্য গ্রামে গেছেন। আসতে দেরি হবে। অনু খুব ভালো, সহজ সরল। সুতপাকে সব বলে দেয় কোনো কিছুই কখনও গোপন করে না। এবার সে সুতপাকে জিজ্ঞেস করে, সুতপা কবিকে দেখেছে কিনা। সুতপা বলে না। অনু তো আকাশ থেকে পরে, কয়েক মাস হয়ে গেল কবি ভাই এসেছে সে কবি থেকে কবি ভাই হয়েছে অথচ সুতপা তাকে দেখেই নাই! সে বলে আজকেই সে কবির সাথে সুতপাকে পরিচয় করিয়ে দেবে।

অনু আরও জানায়, সে কবির কাছে সুতপা সম্বন্ধে বলেছে। সুতপা বলেছে, কেন অনু কবিকে তার কথা বলেছে? তখন অনু বলছে, তার একমাত্র প্রানের বন্ধু সুতপা, মেধাবী, অল্প স্বল্প কবিতা লেখে, পুরস্কার পায়, কারো সাথে মিশে না, শুধু অনুর সাথে সম্পর্ক। অনুকে সে অনেক সাহায্য করে।সুতপাকে অনু অনেক ভালোবাসে।
সুতপার জন্য সে সব কিছুই করতে পারবে। সুতপাকে সে খুশি দেখতে চাই সব সময়। এসব কথা শুনে তো সুতপা মহা খ্যাপা। সে আর অনুর সাথে কথা বলছে না। অনু বুঝতে পারে এগুলো বলা ঠিক হয়নি। পরে কান ধরে মাফ চায় এবং কথা দেয় এ ধরণের কথা সে আর কাউকে কখনও বলবে না।

সুতপা আর অনু কলেজ থেকে ফিরছে। অনুদের বাড়ির সামনে আসতেই ওর বাবার সাথে দেখা। সুতপা ভাবে নিশ্চয়ই কবিও এসেছে। অনু বাবাকে জিজ্ঞেস করে কবি ভাই আসছে কিনা। বাবা বলেন, হ্যাঁ। অনু বলে, চল পরিচয় করিয়ে দিই। সুতপা বলে না, আরেকদিন। সুতপা বাড়ি চলে যায়। হঠাৎ বিকেল বেলা অবাক কান্ড! কবি ভাই এসেছে সুতপাদের বাড়িতে। সুতপা কিছুই বুঝতে পারছে না।

সুতপার বড় ভাই সেও একটু আধটু কবিতা লিখে, তাই কবির সাথে হয়ত ভাব হয়েছে, আর সে কারণেই কবি তাদের বাড়ি এসেছে। ভাইয়ের যা কান্ডজ্ঞান, এখনই হয়ত ডেকে বসবে। ডাকবে কি, ডাকছে। সুতপা শুধু বলে আসছি, ভাই বলে তারাতারি আয় দেখ কে এসেছে, কবি ভাই! আয় পরিচয় করিয়ে দিই। সুতপা ঘরে ঢুকেই কবি ভাইকে সালাম দেয়। কবি ভাই উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রস্তুতি কেমন?

সুতপা বলে ভালো। তারপর বলে কত তারিখ থেকে পরীক্ষা শুরু? সুতপা ডেট জানায়। কবি ভাই বলে ঠিক আছে তুমি যাও। সুতপা উঠতে যাবে অমনি ভাই বলে উঠবি কি রে, কবি ভাই কেন এসেছে জানিস? সুতপা মাথা ঝাঁকায়, বলে না। এবার ভাই বলে, কবি ভাই, ও কিন্তু কবিতা লেখে, ওকে একটু পরামর্শ দেন , আর হয়ত পরীক্ষার আগে আপনার সম্পর্কে ওর কিছু জানা হবে না। এবার কবি ভাই সরাসরি সুতপার দিকে তাকায় । কবি ভাই স্বাভাবিক ভাবেই বলতে থাকে সে কেন এসেছে। কবি ভাই একটু বলার পরই আবার ও বলে, ঠিক আছে তুমি যাও। এবার ভাইও বলে, আচ্ছা যা।

সুতপার মার সাথে কবি ভাই অনেক সময় ধরে কথা বলছে। সুতপার মাও কবি ভাইকে আনন্দ সহকারে নাস্তা খাওয়াচ্ছেন। সুতপা পড়াতে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, একদিনের পরিচয়ে কেউ কখনও এতোটা সময় কারো বাড়ি থাকতে পারে? হয়তো পারে, সে তো আর কখনও এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। শুধু পড়তে জানে। মা কতবার বলেছেন, কোথাও যেয়ে একবার ঘুরে আয়, সে যায়নি। বলেছে কোথাও ভর্তি হতে পারলে তখন যাবে। এ কথা শোনার পর তার বাবা খুব খুশি।

সুতপা কতক্ষণ ধরে যে ভাবছে তার ঠিক নাই। হঠাৎ মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পায়। মা বলেন, কবি ভাই খুব ভালো ছেলে। গ্রামের কত কি যে খোঁজ করল। জেনেও গেলো। আমাদের তিন পুরুষের বাস তাই অনেক অতীতের খবর নিলো। সুতপা দেখে মা খুব খুশি। এই বয়সের মহিলাদের একটা সমস্যা আছে, ঘরে যুবতী মেয়ে থাকলে উপযুক্ত ছেলে দেখলেই তারা নিজেদের শ্বাশুড়ি ভাবে।

সুতপা মার খুশি বেশি দূর যেতে দিতে চাই না। কারন মা পরে আরও কত যে গুনোগান করবে কবি ভাইয়ের, এটা তার জানা। তাই সে বলে, সে কি তোমারও কবি ভাই? এবার মা ঠিকই রেগে ওঠেন, সুতপা যে কোনো কথার গুরুত্ব দেয়নি সেটা মা বুঝতে পারেন। তাই তিনি বলেন না, সবাই বলে তাই! এই বলে মা ঘর থেকে বেড় হয়ে যান।

সুতপা ঘরের দরজা আটকে দেয়। তার মনে বারবার একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই সুতপার সংগে কথা বলার জন্য কত মানুষ অপেক্ষা করে। আর কবি ভাই কিনা তাকে ঘরে বেশিক্ষণ থাকতেই দিলো না। সে কি সুতপাকে নিয়ে খারাপ ধারনা পোষন করেছে? অনুর কাছে শুনে সে কি সুতপাকে অসামাজিক মনে করেছে?

সুতপার কত কি যে মনে হয়, আর রাগ হয় অনুর উপর। আবার ভাবে, তাহলে ওদের বাড়ি এসেছে কেন? হয়তো ভাই জোর করে ধরে এনেছে, আর মায়ের সাথে গল্প, সেটা এতোটা সময় ধরে কেন?? এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে যখন সুতপার মাথা খারাপ অবস্থা তখন ভাইয়ের ডাকে সে দরজা খোলে।

ভাই দরজা খুলে সুতপাকে ধরে বলে, শোন কবি ভাই বলেছে এবার একটা কবিতার বই ছাপা হবে সেখানে আমার একটা কবিতা থাকবে। তোকেও বলেছে লিখতে। এবার সুতপাও ভাইকে ধরে বলে, আর কি বলেছে? ভাই বলছে, কবি ভাই বলেছে তুই খুব সুন্দর, আর ভদ্র। এবার সুতপা বলে কিভাবে বুঝলে আমি ভদ্র? ঐযে সালাম দিলি তাই। সুতপা বলে তুই বানিয়ে বলছিস। না, কবি ভাই বলেছে, আজকাল তো কেউ সালাম দেয় না, তোমার বোন সালাম দিলো বেশ ভদ্র। এই আর কি!

সুতপা ভাবে এটুকুই যথেষ্ট। তার ভাই যা বলবে সেটাই ঠিক। ও কিছু বাড়তি বলবে না। কারণ কবিতা ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। কিন্তু সুতপা এতো কিছু ভাবছে কেন?শেষমেশ বাবার ডাকে তার সব ভাবনা লন্ডভন্ড। বাবা মেয়ের কাছে এসে বসে,মাথায় হাত দেয়। পড়ালেখার খবর জানতে চায়। সুতপা বলে সব ঠিক আছে। বাবা বলেন, অনেক গুড়ুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। মনোযোগ দিয়ে পড়। এই যে একজন ব্যক্তি, যাকে সুতপা খুব, খু-উ-ব ভালোবাসে। তার কথা জীবন দিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

সুতপা মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে পড়তে বসে। সুতপা দিনরাত পড়ে। মা সবকিছু করে দেয় । তাকে পরীক্ষার সময়টাতে কেউ কিছু বলবে না। কোনো দিকেই খেয়াল নাই তার। অনু এসেছে প্রবেশপত্র আনতে যেতে হবে। সুতপা মাকে বলে অনুর সাথে কলেজে যায়। যাওয়ার সময় সে দেখে কবি ভাই অনেক গুলো ছেলের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। আবার আসার সময় দেখে দোকানে বসে আছে। সুতপার কাছে মনে হলো কবি ভাইয়ের মন খারাপ।

সুতপা দ্রুত পা চালিয়ে আসতে থাকে। কবি ভাই তাকে দেখেও দেখে না। কথা বলা তো দূরের কথা তাকালো ও না। সুতপার মন খারাপ হয়, সে কত কি ভাবে-
মনে হয় কতদিনের চেনা, তার জন্যই মনে হয় কবি ভাই অপেক্ষা করছে। সুতপা আবার আস্তে হাঁটে। কিন্তু কবি ভাই অন্য দিকে তাকিয়েই থাকে। কেউ একজন এল তার সাথে কথা বলতে লাগলো। সুতপা অপমানের জ্বালা সহ্য করতে পারছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে কবি ভাই ইচ্ছা করেই এমন করছে। আর সে কবি ভাইকে নিয়ে অযথা ভাবছে।

কবি ভাই দোকান থেকে তার রুমে এসে খাতা নিয়ে বসেছে। গবেষণার কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। লালনের উপর লেখা। অনেক বড় ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু লিখতে ভালো লাগছে না। সুতপা মাথায় আসছে। মেয়েটা বুদ্ধিমতি, দেখতে ভালো। কবিতাও লেখে। অসাধারণ তার অভিব্যক্তি। নাকি তার সুতপাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। আচ্ছা, সুতপা তখন অমন করল কেন, মনে হলো কিছু বলবে। কি বলবে? একদিন ওর সাথে কথা বলতে হবে। ভালো কবিতা লিখলে ছেপে দেব।

কবি ভাই সব ভুলে কাজে মনোযোগ দেয়। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। কারো কোনো খোঁজ ও জানে না। সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। এদিকে সুতপার পরীক্ষা প্রায় শেষ। সুতপাও কবি ভাইকে না দেখে সব আশা ছেড়ে দিয়েছে। ভেবে নিয়েছে এসব মানুষ আউলা ঝাউলা। বুদ্ধির ঠিক নাই। তাই তাকে নিয়ে ভাবনার চিন্তা মাথা থেকে বাদ। সুতপা শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসছে।

কবি ভাই কার সাথে যেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সুতপা কাছে আসতেই সে বলে , পরীক্ষা শুরু হয়েছে? সুতপা বলে আজ শেষ। কবি ভাই বলে, দুঃখিত। সুতপা তার দিকে তাকিয়ে বলে কেন? কবি সুতপার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। সুতপা যে এ কদিনে এমন বড় হয়ে গেছে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সুতপা বলে আসি।

পরদিন কবি সুতপাদের বাড়ি যায় । সুতপাকে অনেক ডাকার পরেও সে দেখা করে না। সুতপাদের বাড়ি থেকে আসার পর কবি ভাইয়ের আর ঘুম হয় না। শুধু সুতপার বাবা, মা, ভাই আর সুতপা-ই কবি ভাইয়ের ভাবনায়।
সুতপাদের দারুণ পরিবার। সবাই শিক্ষিত। সুতপার মায়ের সেকি ব্যবহার! ভুলা যায় না। কবি ভাই কাজ করে আর একটু সময় পর পর সুতপাকে নিয়ে ভাবে।

তার ভাবতে ভালো লাগে। সুতপাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। মাঝে মাঝে এটাও ভাবে, এত বছর বয়সে কেউ মন কাড়তে পারেনি। শেষে কি-না এখানে এসে কুপোকাত! এটা কি প্রেম নাকি ভালো লাগা? সুতপাকে দেখতে চাওয়া না কি কাছে পেতে চাওয়া। সুতপা যে মেয়ে ওকে কিছু বলা যাবে না। ওর মাকে হাত করতে হবে। এরকম অনেক ভাবনা কবির মনে আসে।

কবি ভাই যে কাজে এসেছে সেই কাজ প্রায়ই শেষের পথে। তথ্য উপাত্ত সব পেয়ে গেছে। এখন ঠিকঠাক মতো লিখে জমা দিবে। থিসিস শেষ হবে, সে বিখ্যাত হবে এটাই সবাই বলছে। সবাই দোয়া করছেন। আর দু – মাস দেখতে দেখতে চলে যাবে। কিন্তু সুতপাকে কবি কোথায় পাবে। সুতপা যে এখন তার ধ্যান,জ্ঞান, আরাধনা।

সুতপাও যে কবিকে ভালোবাসে এটা সে বুঝতে পেরেছে। না হলে কেন সে প্রতিদিন একবার করে বাইরে আসে? আবার ভাবে পরীক্ষা শেষ সে বেড়াতেই পারে। সুতপার পরীক্ষা হয়ে গেছে। সে কবিতা লেখে, বই পড়ে। বিভিন্ন ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য নানা প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজকাল সুতপা আর কবি ভাই কে নিয়ে ভাবে না। কিন্তু কবি ভাই সুতপাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না।

সুতপার রেজাল্ট বেড় হয়েছে। জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। সবাই খুশি ।কবি ভাই এসেছে। খুশি প্রকাশ করে দোয়া করেছে। এখন সুতপা কি করবে তা জানতে চেয়েছে। কোন সাহায্য লাগলে জানাতে বলেছে। সুতপা ঘাড় নেড়েছে। কবি ভাই সুতপাকে কি যেন বলতে চাই কিন্তু ওর বাবার কারণে বলতে পারেনা। বাবা সুতপাকে চলে যেতে বলেন।

বাবা কবি ভাইর পরিবারের খোঁজ খবর জানতে চান। কবি ভাই বলে, তার নাম আরিফুর রহমান খান। বাবা মোশাররফ রহমান খান। মা আর দুই ভাই বোনের পরিবার। সে ছোট বোন বড়। বোন কানাডা থাকেন। সেখানে বোন দুলাভাই দুজনেই ডাক্তার। আর সে গবেষক,আপাততঃ একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করে। ঢাকায় ফ্লাট। মা গৃহিনী, বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারী পদস্থ অফিসার ছিলেন। টেলিফোন অফিসে। কুষ্টিয়ায় দাদাবাড়ি।

সব শোনার পর সুতপার বাবা বললেন, দেখ বাবা আমরা খুবই সাধারণ মানুষ। হয়ত তোমার এ বাড়িতে আসতে ভালো লাগে, ভালো কথা। মনে চাইলে আসবে, কিন্তু তিন মাস পর। সামনে সুতপার এ্যাডমিশন টেস্ট। ও ভালো প্রতিষ্ঠানে চান্স পাক এটা আমরা চাই। ওর ভাই রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে সুতপাও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া। কবি সবই বুঝতে পারে। বাবা যে এতোদিন সব খেয়াল করেছেন তাও সে বুঝতে পারে।

বাবা সুতপার ঘরে যেতেই সুতপা বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাবা সুতপাকে বলে,কবি তোমাকে কিছু বলতে চায়। কবি একা বসে আছে। এমন একটা ঘটনা ঘটবে কবি কল্পনা ও করেনি। আবার ভাবে ভালোই হয়েছে। নিশ্চিত হওয়া গেল। সুতপার বাবা একরকম প্রস্তাবই দিলেন আর কি! দারুন স্মার্ট। তিনি যে এতোদিন সব খেয়াল করেছেন এটা কবি টেরই পাই নাই। কবির এখন লজ্জা লাগছে। এদিকে সুতপা আর আসছে না। মা বারবার যেতে বলছে তারপরও না।

সুতপার না আসা দেখে কবি দরজার কাছে এসে বলে, আন্টি আসি। এবার সুতপা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কবি সুতপার দিকে তাকিয়ে বলে আর হয়তো দেখা হবে না, দোয়া করি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হও। সুযোগ পাও। বাবার মনের আশা পূরণ হোক। আর সুতপার হাতে একটা চিরকুট দেয় । চিরকুটের উপর লেখা একবার তাকাও। সুতপার চোখ ছলছল করছে, মনে হচ্ছে এখনই বৃষ্টি হবে, আর দেখা হবে না। কবি ভুলে যাবে, সে ভুলতে পারবে না।

সুতপার মা নাস্তা নিয়ে আসে। সুতপা কাঁদছে, সুতপা মাকে জড়িয়ে ধরে আরও কান্না করে। মা বলেন ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে। কবি বলে, আসি। পনেরো দিন পর কবি চলে যায় । সুতপাও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়। কবি মাঝে মাঝেই আসে কারণ দাদা বাড়ি কুষ্টিয়া।

কবি একবার মাকে নিয়ে সুতপাদের বাড়ি আসেন। কবির মা সুতপাকে দেখে মহাখুশি। তিনি আংটি পড়াতে চান। কিন্তু সুতপার বাবা বলেন, অনার্স শেষ হোক। পরে দেখা যাবে। অনার্স শেষে মাষ্টার্স কমপ্লিট তখন কবি বাবা – মা দুজনকেই নিয়ে এসেছেন। এখন সুতপার বাবা বলেন, একটা চাকরি হোক। তারপর ধুমধাম করে বিয়ে হবে।।

কবির বাবা আংটি না পড়িয়ে কিছুতেই যাবেন না। কিন্তু সুতপার বাবার মধুর ব্যবহারের কাছে তারা পরাজিত হন। সুতপার চাকরি হয়েছে। কবি অপেক্ষায় আছে। তার বোন, দুলাভাই, বাবা, মা সবাই আসবেন। কিন্তু সুতপার বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। তিনি সুতপাকে নিয়ে রাজশাহী যেতে চান। সুতপার মা এবার কারণ জানতে চান। সুতপার বাবা আর চুপ থাকতে পারেন না। তিনি বলেন সম্ভব না। এই বিয়ে যদি হয় তাহলে আমাকে অনুর বাবা মেরে ফেলবে। কারণ অনুর মা চায় কবির সাথে অনুর বিয়ে হবে। অন্য কারো না। অনুও রাজি, দেখ না? অনু এখন এ বাড়িতে আর আসে না।

সুতপা সব বুঝতে পারে। সে বাবাকে রাজশাহী নিয়ে যেতে বলে। ফুফাত ভাইকে সে বিয়ে করবে। তবুও বাবাকে কিছু হতে দিবে না।
সবকিছু শোনার পর সবাই সিদ্ধান্ত নেয় রাজশাহী যাবে। সেখানে সুতপার বিয়ে হবে। সব যখন কমপ্লিট তখন কবির ফোন আসে। সুতপার ভাই কবিকে সব বলে দেয়। কবি উম্মাদ হয়ে ওঠে। এতো অপেক্ষার মূল্য এইটা? সুতপার বাবা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। সে কিছুতেই মানবে না।

অবশেষে কবি একটা দিন সময় নেয়। তিনি সুতপাদের বাড়ি নয় কুষ্টিয়া দাদা বাড়ি আসে। কবির মামা সুতপা আর তার বাবাকে একবারের জন্য যেতে অনুরোধ করেন, না হলে তিনি সুতপাদের বাড়িতে কবিকে নিয়ে আসবেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা রাজি হয়ে যান। তারা সেখানে যায়। কবিকে পাগলের মতো মনে হচ্ছে সুতপার কাছে, মনে হচ্ছে সে যা খুশি তাই করে ফেলতে পারবে। হলোও তাই, কবি হুট করে এসে সুতপাকে জড়িয়ে ধরে, আর ছাড়তে চায় না। শেষে বাবার হস্তক্ষেপে কবি শান্ত হয়।

কবির মামা এসেছেন তিনি কলেজের শিক্ষক। তিনি সব জানতে চান সুতপার বাবার কাছ থেকে। সুতপার বাবা এবার অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তিনি বলেন, আমি কবিকে অনেক ভালোবাসি। মনে মনে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করি, হঠাৎ দেখা হয় মহব্বত ভাইর সাথে। তার বাড়িতেই কবি থাকত। মহব্বত ভাই এলাকার ধনী, তাকে সবাই সম্মান করে। তাছাড়া কবির উপর তার একটা দাবী ও আছে, তার বউ কবিকে মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চায়।

যদি সুতপার সাথে কবির বিয়ে হয় তাহলে মহব্বত সাহেবের লোকজন তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিবে। সবকিছু শুনে মামা সমস্ত দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেন। কিন্তু সুতপা শান্তি পাচ্ছে না। তার ধারনা কিছু একটা ঘটবে। সেটা যে কি, তা সে বুঝতে পারছে না। কবির মামা সুতপাদের রাতটা থাকতে বলেন, সুতপার বাবাও রাজী হয়ে যান। সুতপা জানালা ধরে কত কি যে ভাবতে থাকে, হঠাৎ তার ভাবনায় চলে আসে অনু।

সে নিজেই নিজেকে বলে, অনু কি এটা মেনে নেবে? অনুই তো কবির সাথে তাকে সম্পর্ক গড়ে দিয়েছে। সুতপার মন খারাপ অনু কখনও সহ্য করবে না। হয়ত অনুর বাবা – মা জোর করে তাকে আটকে রেখেছে কিন্তু যদি ও একবার ছাড়া পায় তাহলে সোজা সুতপার কাছে আসবে। তখন তো অনু সুতপাকে পাবে না। সে নিশ্চয়ই কোনো দূর্ঘটনা ঘটাবে। সুতপা ভয়ে কাঁপছে, বাবা আসে সুতপাকে শান্ত করে। বলে সকালেই চলে যাবে।

সুতপা শুয়ে আছে। কবি আসে, এখন তাকে অনেক স্বাভাবিক লাগছে। সুতপা উঠে বসে, কবির হাত ধরে নিজের কাছে বসতে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কবি সুতপার দিকে অসহায়ের মতো তাকায়, শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও সে সুতপাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটা দমন করে। হঠাৎ সুতপা-ই অবাক-কান্ড করে বসে। সে কবিকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।

কবিও অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু সুতপার বাবার কথা মনে পড়তেই সে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সে দ্রুত ঘর থেকে বেড় হয়ে যায় । সুতপার আর কিছুই ভালো লাগছে না। সে কবিকে চাই, তাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। সে আবার ও কবির কাছে যায়, কিন্তু তাকে সে না পেয়ে ফিরে আসে।

সুতপার বাবার ঘুম আসছে না। কি হবে ভেবে অস্থির। তার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে তিনি সহ্য করতে পারছেন না। হঠাৎ রাতেই তার কাছে ফোন আসে, অনু পালিয়ে এক বন্ধুকে বিয়ে করেছে। সুতপার বাবার কাছে অনুর বাবা সব বলছে, মেয়ের জন্য দোয়া চেয়েছে। বাবা আসেন সুতপার ঘরে, সুতপাকে কিছুই জানান না। এদিকে কবির মামা সুতপার বাবাকে কবির শেষ আকুতিটুকু জানান। বলেন আরেকবার ভেবে দেখতে।

বাবা ভাবেন, মেয়ের কাছে বসেন। বলেন, কাজী ডেকে আজই বিয়ে দিয়ে দিই? ভাগ্যে যা থাকে তা হবে! সুতপা লজ্জা পায়, বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাবা শান্তি পাচ্ছেন। মেয়ের মনের আশা পূরণ করতে যাচ্ছেন। তার কাছে এর থেকে ভালো কিছু এ জীবনে হয়নি।বাবার আনন্দ আর থামে না, মনে মনে একা একা কত কথা যে বলছেন, সুতপার মা থাকলে হয়ত ঝগড়াই বেধে যেতো!

বাবা ভাবেন তিনি এমন একটা সারপ্রাইজ সুতপাকে দিতে যাচ্ছেন যা শুনে সুতপা হাসতে অহাসতে অজ্ঞান হয়ে যাবে। বাবা, মেয়ের সেই হাসিটাই দেখতে চাই। মনে অনেক কষ্ট লাগছে। সুতপাকে আর আগের মতো পাবেন না, যখন তখন ডাকতে পারবেন না, হলে কি হবে, তারপরও মেয়ের আনন্দই বড় তার কাছে। মামা রাতেই সব আয়োজন করেন কোনো কিছুই কেউ জানলো না বিয়ে হয়ে যায়।

কবি সুতপাকে কষ্ট দিতে চায় নাই। মামাকে হাতে পায়ে ধরে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলো, কোনো সমাধান না হলে কবি আর ঘরে ফিরতো না। সুতপার বাবা একবার যদি এখান থেকে যান তাহলে তিনি সুতপাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিবেন। সুতপাও এটা জানত তাই সে কবিকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিল না। সুতপা কষ্ট পাচ্ছিলো। কবি ও কষ্ট পাচ্ছিলো। কবি কিছুতেই সুতপাকে কষ্ট দিতে পারবেন না। এই প্রথম সুতপা তাকে আলিঙ্গন করেছে, ভালোবেসেছে!#

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *