হলিউডের সিনেমার দর্শকদের কাছে অনবদ্য এক নাম ক্রিস্টোফার নোলান। ভিন্নমাত্রার সিনেমা বানিয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন অসামান্য প্রতিভাবান এই নির্মাতা। সারা বিশ্বের দর্শকরা মুখিয়ে থাকেন তার সিনেমার জন্য। এ যাবৎ তার নির্মিত সবগুলো সিনেমাই দর্শক-সমালোচকদের মন কেড়েছে। সবশেষ ‘ওপেনহেইমার’ দিয়ে বিপুল সাড়া জাগিয়েছেন। জয় করে নিয়েছেন দু’টি অস্কার। নোলান এমন একজন নির্মাতা যার ছবি দেখার আবেদন কখনো ফুরায় না। একই ছবি বারবার দেখেও যেন দেখার আগ্রহ থেকে যায়।
সেই আঙ্গিকে বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য নোলানের পুরনো দু’টি ছবি আবার পর্দায় নিয়ে আসছে স্টার সিনেপ্লেক্স। নতুন করে মুক্তির জন্য নোলানের ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা দু’টি ছবিকে বেছে নেয়া হয়েছে। ছবিগুলো হলো, ‘দ্য ডার্ক নাইট’ এবং ‘ইন্টারস্টেলার’। ৩ মে একসঙ্গে ছবিগুলো মুক্তি পাবে স্টার সিনেপ্লেক্সের সবগুলো শাখায়। এ প্রসঙ্গে স্টার সিনেপ্লেক্সের মিডিয়া ও মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ক্রিস্টোফার নোলানের ছবি নিয়ে বরাবরই দর্শকদের বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। সম্প্রতি ওপেনহেইমার অস্কার পাওয়ার পর অনেক দর্শক আমাদের কাছে এ ছবিগুলো নতুন করে হলে আনার জন্য অনুরোধ করেছেন। দর্শকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমরা এ দু’টি ছবি হলে আনছি। আশা করি দর্শকরা ছবিগুলো উপভোগ করার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত হবেন।’
‘দ্য ডার্ক নাইট’ ব্যাটম্যান সিরিজের সফলতম ছবি। এটি ২০০৮ সালের ১৮ জুলাই মুক্তি পেয়েছিল। ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি বক্স অফিসে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছিল ছবিটি। এতে অভিনয় করেছেন ক্রিশ্চিয়ান বেল, মাইকেল কেইন, হিথ লেজার, গ্যারি ওল্ডম্যান, মরগান ফ্রিম্যানের মতো তারকা। অন্যদিকে ‘ইন্টারস্টেলার’কে বলা হয় মহাকাশ বিষয়ে অন্যতম সেরা সিনেমা। এতে অভিনয় করেছেন ম্যাথিউ ম্যাককনাফি, অ্যানি হ্যাথওয়ে, জেসিকা চাস্টেইন, এলেন বারস্টিন প্রমুখ। ২০১৪ সালের ৭ নভেম্বর মুক্তি পাওয়া ছবিটির বক্স অফিস কালেকশন ৭৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
‘দ্য ডার্ক নাইট’
ওয়ার্নার ব্রসের তত্ত্বাবধানে নির্মিত দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলজির মাধ্যমে পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান যেন নতুন করে জন্ম দিলেন ডার্ক নাইটকে। গৎবাঁধা কমিকের গল্প থেকে সেটি সম্পূর্ণ আলাদা। নতুনভাবে চিত্রায়িত এই কিংবদন্তীর মাঝে দর্শকরা অবলোকন করলো ডার্ক নাইটের দাপুটে প্রত্যাবর্তন। রূপালী পর্দার সামনে যেন পুরাতন মেন্যুতে নতুন রেসিপি। সমালোচকদের পাশাপাশি হলফেরত দর্শকদের অনুভূতিতে প্রকাশ পেয়েছে নোলান ও তার ট্রিলজির জয়জয়কার। ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমায় সাসপেন্স আপনাকে ভুল দিকে টেনে নিয়ে যাবে। আপনি যখন চরম উত্তেজনায় নখ কামড়ে মরছেন, ঠিক তখন পরিচালক আপনাকে সম্পূর্ণ ভিন্নদিক থেকে আক্রমণ করবেন। সাসপেন্সের উপর নতুন সাসপেন্স আপনাকে বেশ কিছু শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত উপহার দেবে। একদিকে ব্যাটম্যানের লড়াই, অপরদিকে ক্লাইম্যাক্সে সমান তালে বুঁদ হয়ে থাকা উত্তেজিত দর্শক! কী নেই এই সিনেমাতে! ১৫২ মিনিটের দীর্ঘ সময় ধরে যেন আপনি ব্যাটম্যানের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটবেন জোকারের পেছনে।
প্রথম ছবি মুক্তির প্রায় তিন বছর পর, ২০০৮ সালে নোলান আবার ফিরে আসলেন ব্যাটম্যান নিয়ে। তবে ব্যাটম্যানের সিনেমা হওয়া সত্ত্বেও এবারের সিনেমার নামের আগে পিছে কোথাও নেই তার নাম। প্রথমবারের মতো কোনো ব্যাটম্যান সিনেমা নির্মাণ করা হলো তার নাম ব্যবহার না করেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতে করে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি সিনেমার সাফল্যে, বরঞ্চ গড়ে এক নতুন ইতিহাস। ‘দ্য ডার্ক নাইট’ নামে মুক্তি পাওয়া সেই সিনেমাটি বক্স অফিস কাঁপিয়ে আয় করে নেয় প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এর আগে কোনো সুপারহিরো ধারার সিনেমা এক বিলিয়ন ডলার আয়ের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারেনি। আগের কাস্টিংয়ের সাথে এবারে সিনেমায় যুক্ত হন অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা হিথ লেজার। আগে ক্যাটি হোমসের অভিনয় করা র্যাচেল ডস চরিত্রকে আরও পরিপূর্ণতা দিতে তার জায়গায় অভিনয় করেন ম্যাগি ইলেনহল। আর এই সিনেমায় অনেকটা নিজের সাথেই যেন প্রতিযোগিতা করতে নেমেছিলেন ক্রিশ্চিয়ান বেইল। তবে এবারে তার ফোকাসটা ব্যাটম্যান থেকে ব্রুস ওয়েইনের উপরই যেন একটু বেশি ছিল। আর যাকে নিয়ে বলতেই হয়, তিনি হলেন হিথ লেজার। কী অসাধারণ অভিনয়! কেউ কল্পনাও করেনি জ্যাক নিকলসনের পর জোকারকে এভাবে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারবে। দুই মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি জোকারকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন এক উচ্চতায়। সহ-অভিনেতা হিসেবে জিতেছেন সে বছরের গোল্ডেন গ্লোব ও একাডেমি পুরস্কার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সিনেমা মুক্তির কিছুদিন আগে মারা যান লেজার। সিনেমা কিংবা পুরস্কার কোনোটাই দেখার সুযোগ হয়নি তার।
ইন্টারস্টেলার
‘ইন্টারস্টেলার’ প্রেমের সিনেমা নয়। তবে এটা নিছক একটা সাই-ফাই থ্রিলারও নয়। মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নিরন্তর লড়াইয়ের গল্প বলে সিনেমাটি। প্রায় তিন ঘণ্টার এই সিনেমা তাই কল্পকাহিনির বলয় ভেদ করে ছুঁয়ে যায় মানবতার সবচেয়ে মহান স্তরকে। বরাবরের মতোই দর্শককে ভাবিয়ে তোলার পুরো আয়োজনই করেছেন নোলান। ‘ইন্টারস্টেলার’ এমন এক সময়ের গল্প বলে যখন পৃথিবী আর সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা নয়। পৃথিবীর নিষ্ফলা প্রান্তরে বারবার আঘাত হানে প্রচন্ড ধূলিঝড়। মানুষ ফিরে গেছে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায়। আর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পেছনে অর্থ বিনিয়োগ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজে খরচ। এমনই এক সময়ে নাসার সাবেক পাইলট এবং অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার জোসেফ কুপারের বাড়িতে ঘটে যায় এক অদ্ভূত ঘটনা। একটি ঘরে তারা আবিষ্কার করেন মাধ্যাকর্ষণ বলয় যার মাধ্যমে বাইনারি সংকেতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে কেউ। নাসার পরিত্যক্ত আর্কাইভের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন কুপার, যেখানে তার দেখা হয় প্রফেসর জন ব্র্যান্ডের সঙ্গে। বৃদ্ধ এই বিজ্ঞানী কুপারকে বলেন, নাসা এখনও গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মহাকাশ গবেষণা। চল্লিশ বছর আগে তারা খোঁজ পেয়েছিলেন এক ওয়ার্মহোলের।
তাদের মতে শনি গ্রহের বলয়ের কাছে হঠাৎ করে তৈরি হওয়া এই ওয়ার্মহোলটির মাধ্যমেই পৌঁছে যাওয়া সম্ভব গার্গেনচুয়া নামের অন্য গ্যালাক্সিতে অবস্থিত এক বিরাট কৃষ্ণগহ্বরের কাছে, যেখানে আছে মানুষের বসবাসের সম্ভাবনাযুক্ত তিনটি গ্রহ। চল্লিশ বছর আগেই সেই তিন গ্রহের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন তিন মহাকাশচারী মিলার, এডমান্ডস আর মান। এখন সময় এসেছে তাদের খুঁজে বের করার এবং দ্রুত বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তে থাকা পৃথিবী ছেড়ে সেই তিন গ্রহের একটিতে নতুন করে মানববসতি স্থাপনের। ব্র্যান্ড কুপারকে প্রস্তাব দেন তাদের এই ‘ল্যাজারাস মিশনে’ যোগদান করার। নিজের দুই সন্তানকে পেছনে ফেলে প্রাণিবিদ অ্যামেলিয়া ব্র্যান্ড, ভূতাত্ত্বিক ডয়েল, পদার্থবিদ রোমিলি এবং দুই রোবট টার্স ও কেইসকে নিয়ে ‘এনডিউরেন্স’ নামের মহাকাশযান নিয়ে কুপার শুরু করে এক অনিশ্চিত যাত্রা। আর এখান থেকেই আসলে শুরু ‘ইন্টারস্টেলার’-এর গল্প। প্রতিবারই নোলান স্বকীয় ভঙ্গীতে মানুষের ক্ষমতার জয়গান গেয়েছেন। সেদিক থেকে দেখলে ‘ইন্টারস্টেলার’- এ নিজেকেই ছাঁড়িয়ে গেছেন এই পরিচালক। ‘ইন্টারস্টেলার’ নোলানের সেই ওয়ার্মহোল, যার মধ্য দিয়ে মানুষকে নিয়ে তার স্বপ্নকে পৌঁছে দিয়েছেন সর্বোচ্চ চূড়ায়।