ঢাকা- ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেছেন, ‘এরশাদ সরকারের নয় বছরে ৩৭০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ৬১ জন মানুষ নিহত হয়েছিলেন। আর শেখ হাসিনার সরকার মাত্র দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) ১ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। যুদ্ধ অবস্থা ছাড়া পুরো পৃথিবীতে এটি খুবই বিরল। কোনো একটি সিভিল সরকার তার জনগণের মধ্যে ১ হাজার জনকে হত্যা করেছে। খুব বেশি নজর খুঁজে পাবেন না।’
আজ সকালে ‘গুড গভর্নেন্স ফোরাম’ এর উদ্যোগে “রাষ্ট্র সংস্কারে সকলের অংশগ্রহণ একাত্মতা ও অংশগ্রহন দরকার” শীর্ষক জিজিএফের গোলটেবিল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বুধবার সকালে রাজধানীর মহাখালীর সেনা কল্যাণ টাওয়ার,আমানা ফুড ভ্যালী কনফারেন্স হলে সকাল ১১টায় ‘গুড গভর্নেন্স ফোরাম’ এর আয়োজনে নতুন বাংলাদেশ: “রাষ্ট্র সংস্কারে সকলের অংশগ্রহণ একাত্মতা ও অংশগ্রহন দরকার” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাবি শিক্ষক রোবায়েত বলেন, ‘নিহতদের মধ্যে ৭৪ জন শিশু। ৪০০ জন মানুষ অন্ধ হয়ে গেছে, এক চোখ কিংবা দুই চোখ। ২০ হাজার জন মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছে চিরতরে। এসব যদি মাথায় না রেখে আমরা আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের কথা বলি তাহলে সহজে বিষয় না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধ্যায় লেখা হবে। বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধান কোনো দিন পালিয়ে যায়নি। বঙ্গবন্ধু এখানে নিহত হয়েছেন। জিয়াউর রহমান এখানে নিহত হয়েছেন। এরশাদ জেল খেটেছেন। পালিয়ে কোনো দিন যাননি। তাই অনেক নতুন ফিচার এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’
শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের ঝোঁকই ছিল স্বৈরাচারী হওয়া। কোনো ক্ষমতার ঝোঁকই হচ্ছে স্বৈরাচারী হওয়া। এ কারণে পলিটিক্যাল ফিলোসফারদের সারাক্ষণই চিন্তা ছিল ক্ষমতাকে কীভাবে আটকে রাখা যায়। এটিকে কীভাবে চোখে চোখে রাখা যায়। এটিকে কীভাবে পাহারা দিয়ে রাখা যায়।’
আলোচনা সভায় বিচারক ইকতেদার আহমেদ বলেন, ‘২০০৮–এর নির্বাচন থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নির্বাচন অবৈধ। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে। ভোট গ্রহণ রাতে হয় না। দিনেই হয়।’
তিনি বলেন, ‘এসব নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সবাই অবৈধ। তারা যেসব বেতন ভাতা নিয়েছে, সেগুলোও অবৈধ। তাদের এসব বেতন ভাতা আদায়ের জনগণ দাবি তুলতে পারে।’
এ সময় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, ‘সমাজের সবাই নেতৃত্বদানকারী। এখানে কাউকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।’
তিনি বলেন, ‘গুড গভর্নেন্স মানে কোনো পক্ষ–বিপক্ষ নয়, নিরপেক্ষ। তার কোনো পক্ষ থাকতে পারে না। সব জনগণের জন্য যেটা কল্যাণকর সেটা হচ্ছে সুশাসন। দল মত বর্ণ নৃগোষ্ঠী নিয়ে জাতিগত বৈষম্য দূর করতে হবে। সেই সঙ্গে দলবল নির্বিশেষে নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ চাই। তা ছাড়াও আমরা শান্তি সমৃদ্ধি, সৌহার্দ্য, ভালোবাসার বাংলাদেশ চাই।’
গণ সংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘১৯৬৯ পর ১৯৭১ এসেছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর এসে দেখলাম তারা ১৯৭০–এ এসে দাঁড়িয়ে আছে। ৭১ সালকে অস্বীকার করার মতো ঘটনা ঘটেছে।’
আলোচনা সভায় মেজর জেনারেল (অব.) আমসা আমিন বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের ঐক্য ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘জনগণের নাম দেওয়া দরকার ছিল নির্বাচক। আমরা বলব, আমাদের নির্বাচন করেছে। প্রতিটি ইট এক নম্বর হলেই একটি এক নম্বর বিল্ডিং সম্ভব। ভালো নাগরিক ছাড়া ভালো সরকার হয় বলে আমি মনে করি না।’
সংস্কার পার্টির নির্বাহী আহ্বায়ক মেজর (অব.) আমীন আহমেদ আফসারী বলেন, ‘এই সরকারের ফেল মানে সবার ফেল। এটা সবার সরকার, সেই বিশ্বাসটা সবাইকে ধারণ করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সরকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে আমাদের সকলেরই পাশ হবে।’
বিচারপতি সিকদার মকবুল হক বলেন, ‘আন্দোলনে যেসব আত্মত্যাগ করা হয়েছে তার ফসল এখনো আমাদের কাছে আসেনি। এর জন্য সবাইকে একত্রিত হতে হবে। যারা এই অর্জনে বিরুদ্ধে এখনো কাজ করতেছে তাদের কাছে এখনো লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা আছে। যেটা এই সরকারের কাছে নেই। কোনো ব্যাংকে নেই। কোন পলিটিক্যাল পার্টির কাছে নেই। শেষ দিনও নাকি আন্দোলন বানচাল করার জন্য কোটি কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যেসব টাকাগুলো রয়ে গেছে।’
আলোচনা সভার সভাপতির বক্তব্যে সাবেক বিচারপতি মকবুল বলেন, ‘যারা কোটাবিরোধী আন্দোলন করেছে তারা দেশের ভালো চায়। শুধু যে আন্দোলন ছাত্ররাই করেছে তাই নয়। জনগণও সঙ্গে ছিল।’
তিনি বলেন, ‘কোনো অভ্যুত্থান হলে আইন ভাঙতেই হয়। আইনের মধ্য থেকে কখনো অভ্যুত্থান হয় না। সংবিধানের মূল কথা হলো জনগণই দেশের মালিক। সংবিধান অনুযায়ী সংশোধন করা হয়েছে, সেগুলো দলীয়, রাজনৈতিক ও পারিবারিক কারণে হয়েছে। কিন্তু জনগণের স্বার্থে কোন কিছুই হয়নি। তাই সংবিধান নতুন করে বানাতে হবে, না হলে আগেরটাকে নতুন করে সংশোধন করতে হবে।’
‘গুড গভর্নেন্স ফোরাম’ এর পক্ষে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিচারক ইকতেদার আহমেদ। এবং ফোরাম এর পক্ষ থেকে ধারণাপত্র পাঠ করেন শহিদুল ইসলাম খান। সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি সিকদার মকবুল হক।উক্ত গোলটেবিল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন শরিফুল ইসলাম খান, সাধারণ সম্পাদক,জিজিএফ।
উক্ত গোলটেবিল আলোচনায় আলোচক হিসেবে ছিলেন, অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নৈতিক সমাজের সভাপতি মেজর জেনা: আমসা আমিন, মাহবুর আলম কমল, সংস্কার পার্টির আহবায়ক মেজর আমিন আহমেদ আফসারী ও এডভোকেট তাসমিন রানা। (ভার্চুয়ালী) বক্তব্য রাখেন ড.রেজাউল করিম চৌধুরী প্রমুখ।