শনিবার, জানুয়ারি ১৮Dedicate To Right News
Shadow

ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই ড্যাপ এর বারবার সংশোধন করছে রাজউক: আইপিডি

Spread the love

সম্প্রতি ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর যে সকল সংশোধনীর প্রস্তাব রাজউক প্রকাশ করেছে, সেখানে শহরের বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদি, পরিবেশ প্রাধান্য পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক স্বার্থ।

ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে ড্যাপ (২০২২-৩৫) চূড়ান্ত হবার দুই বছরের মধ্যে দুইবার ড্যাপ সংশোধন এর উদ্যোগ নেয়া হল। ড্যাপ সংশোধন প্রক্রিয়ায় রাজউকের কতিপয় কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। বাসযোগ্যতার তলানিতে থাকা ঢাকা শহর থেকে ব্যবসায়িক মুনাফা ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেবার সংস্কৃতি জুলাই গণ অভ্যুত্থান উত্তর বাংলাদেশে কাম্য ছিল না। এই প্রবণতা চলতে থাকলে যানজট-দূষণে স্থবির ও অবাসযোগ্য হয়ে পড়া ঢাকা আরও নিশ্চল হয়ে পড়বে। এ থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনাগত টেকসই কৌশল ও পন্থা কাজে লাগিয়ে জনস্বার্থ, বাসযোগ্যতা, জনস্বার্থ ও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়েই ড্যাপের প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা করতে হবে।

উপরোক্ত মতামতগুলো উঠে আসে আজ ৪ ডিসেম্বর, বুধবার, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পর্যালোচনা বিষয়ক অনলাইন অনুষ্ঠানে, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, “কোন স্বার্থে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর বারংবার সংশোধনের উদ্যোগ: আইপিডি’র পর্যবেক্ষণ”।

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র পক্ষ থেকে পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ড্যাপ সংশোধনে রাজউকের সংশোধনীতে ভবনের আকার-উচ্চতার বাড়ানোর প্রস্তাবনা ছাড়া অন্য কিছু আসেনি। বন্যা প্রবাহ এলাকা, জলাভূমি, কৃষিজমি রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষায় থেকেছে। আমরা বলে এসেছিলাম, আবাসন ব্যবসায়ী ও কিছুসংখ্যক পেশাজীবিরা ড্যাপ বাতিল বা স্থগিতের আবেদন করছে শুধুমাত্র ভবন নির্মাণে বেশি এফএআর (ফার) মান বাড়ানোর জন্যেই। আমাদের সেই শংকাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। ড্যাপ সংশোধনে প্রস্তাবিত এরিয়া ফার ও ব্লকভিত্তিক ফার মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাসযোগ্য শহর নির্মাণে পরিকল্পনার ব্যকরণ অনুসরণ করা হয়নি। ফলে ড্যাপে প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতাকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।

আইপিডি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, বড় শহরের জনঘনত্ব সাধারণত একরপ্রতি ১০০-১০০ জন বা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫ – ৩০ হাজার হয়। এই জনঘনত্বও শহরের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু নগর এলাকায় থাকে, যা শহরের প্রান্তের দিকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। চূড়ান্ত ড্যাপে ঢাকার অপরিকল্পিত এলাকা জিনিজিরা’র জনঘনত্ব কাঠাপ্রতি পরিবারসংখ্যা ১.২ বা একরপ্রতি ১৫০ দেয়া থাকলেও ১৮ নভেম্বর এ রাজউক প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ১৫০ শতাংশ বেড়ে কাঠাপ্রতি পরিবারসংখ্যা ৩.০ বা একরপ্রতি প্রায় ৩৫০ জন প্রস্তাব করা হয়েছে। এই এলাকার আগে প্রস্তাবিত এফএআর মান ১.৩ থেকে ১৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩.৩। একইসাথে ওয়েবসাইটে আপলোডকৃত প্লটভিত্তিক ফার সূচকে A3 (ফ্ল্যাট ও এপার্টমেন্ট বাড়ি) ক্যাটাগরির ফার মানসমূহ যেভাবে অপরিপক্কভাবে কেটে দিয়ে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক। ব্লক ডেভেলপমেন্ট এর ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক ফার বোনাস সাধারণত ১৫ – ২০ শতাংশ হয়ে থাকে। অথচ রাজউক এলাকাভিত্তিক ফার মান এর তুলনায় ব্লকভিত্তিক ফার মান ৯০ – ১২০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রস্তাব করেছে, যা বৈশ্বিক পরিকল্পনা কৌশলের সাথে সাংঘর্ষিক। এভাবেই অনেক এলাকারই ফার মান অযাচিতভাবে বেড়েছে। ফলে এসব এলাকার বাসযোগ্যতা আরো সংকটে পড়বে বলে মনে করে আইপিডি।

অনুষ্ঠানে আইপিডির অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, একটি বসবাসযোগ্য শহরে শুধু আবাসন নয়; পরিবেশ, প্রতিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন ইত্যাদি বিষয়েও গুরুত্ব দেয়ার কথা। অথচ আমাদের ব্যবসায়ী মহল কেবল ড্যাপ বাতিল এবং ফার বৃদ্ধির কথাই বলছে। এমনকি ফার বৃদ্ধি করা হলে ভবিষ্যতে ওই এলাকা বসবাসযোগ্য থাকবে কিনা তা নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। রাজউকের নীতিনির্ধারক মহলের অনেকেই নগর পরিকল্পনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারায় স্বার্থান্বেষী মহলের অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করছেন। গোষ্ঠীস্বার্থ চিন্তা না করে ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াতে জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পরিকল্পনাবিদ রাকিবুল রনি বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থের সংঘাত এর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ড্যাপ পুনর্মূল্যায়ন কমিটিতে রিহাবের সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি বৈষম্যবিরোধী চেতনার প্রতিফলন ঘটায় না। আমাদেরক স্থপতিদের খেয়াল রাখা দরকার তারা যেন তাদের পেশাগত নৈতিকতা এবং জনস্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধতা মাথায় রেখে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট মতামত দেন, ব্যবসায়িক স্বার্থকে যেন অগ্রাধিকার না দেয়া হয়।

স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন বলেন, স্থপতিরা কেবলমাত্র ফার বাড়ানোর কথা বলেননি, সাথে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার অন্যান্য বিষয়েও মতামত দিয়েছেন। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয় বিধায় ঢাকায় আগত মানুষদের বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িত বিশাল জনগোষ্ঠীর কথাও খেয়াল রাখতে হবে আমাদের।

পরিবেশকর্মী আমিরুল রাজিব বলেন, ড্যাপ নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবিদের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের দায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরেও বর্তায়। দেশের প্রতিটি শহর ঢাকাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। ফলে ড্যাপ এর যে কোন সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হতে হবে। রিহাবের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। নাগরিক অধিকারের স্থান থেকে শহরের নাগরিক সুবিধাদি বাড়াতে সরকারি সংস্থাসমুহের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কেবল মানুষ নয়, প্রতিটা প্রাণী ও কীটপতঙ্গের কথাও বিবেচনা করে শহরের পরিকল্পনা করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, একটি শহরের ধারণ ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনার সকল সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের কেবলমাত্র মুনাফা লাভের চিন্তা শহরের উন্নয়নের অন্তরায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *