শনিবার, মার্চ ২২Dedicate To Right News
Shadow

দুর্বল প্যারেন্টিং এর ফাঁদে আগামী প্রজন্ম!

Spread the love
  • রেজাউর রহমান রিজভী

গত ক’দিন ধরে দেশের সোস্যাল মিডিয়া সহ মেইনস্ট্রিম সকল মিডিয়ার অন্যতম একটি সংবাদ শিরোনাম ছিলো ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে নিখোঁজ ১১ বছরের ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া বয়সী কিশোরী আরাবি ইসলাম সুবা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সুবার বাবার কন্যার নিখোঁজ সংক্রান্ত একটি পোস্ট দিলে মুহূর্তে তা ভাইরাল হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মিডিয়া তারকারাও পোস্টটি শেয়ার করে সুবার খোঁজ দিতে সকলকে অনুরোধ করেন। দেশের সকল গণমাধ্যমও সংবাদটিকে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখে ও শেষ পর্যন্ত সুবার খোঁজ দিতে পারে। সচেতন পাঠকদের প্রায় সকলেই এ পর্যন্ত জানেন। তবে এই আলোচনার বিষয় সুবার নিখোঁজ বা পাওয়ার বিষয় নয়। বরং এই ঘটনা প্রবাহের পেছনে যে দুর্বল প্যারেন্টিং অন্যতম ভূমিকা রেখেছে সেই বিষয়েই আলোকপাত করা হবে।

প্যারেন্টিং কি?

প্যারেন্টিং এর আভিধানিক অর্থ অভিভাবকত্ব। মোটা দাগে, প্যারেন্টিং হলো শিশুদের লালন-পালন, যত্ন ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে তারা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিকভাবে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে। এটি শুধুমাত্র খাবার, আশ্রয় বা শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং ভালো মূল্যবোধ শেখানো, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা এবং জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করাও প্যারেন্টিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

প্যারেন্টিং-এর মূল দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে- শিশুর প্রতি ভালবাসা, যত্ন, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, শিক্ষা, দিকনির্দেশনা, যোগাযোগ, বোঝাপড়া, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা প্রভৃতি বিষয়গুলো। সঠিক প্যারেন্টিং এর মাধ্যমে শিশুকে সুরক্ষা ও ভালোবাসা দেওয়া যায়, যাতে সে নিরাপদ ও গুরুত্বপূর্ণ অনুভব করে। এছাড়া সঠিক আচরণ শেখানো ও ভুল সংশোধন করা হয়। এর পাশাপাশি শিশুকে ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝানো এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করাও অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। সেই সঙ্গে শিশুর অনুভূতি ও চাহিদা বোঝা এবং খোলামেলা কথা বলা, শিশুকে উৎসাহ দেওয়া, তার দক্ষতাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নতুন কিছু শেখার সুযোগ দেওয়াও প্যারেন্টিং এর মধ্যে আসবে।

প্যারেন্টিং একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। একজন মানুষ সঠিক প্যারেন্টিং এর মাধ্যমে তার শিশুকে যেমন ঠিক ভাবে লালন-পালন করতে পারবেন। তেমনি পরবর্তীতে এই শিশু যখন প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে তার সন্তানকে লালন পালন করবে, তখন সেও সঠিক নিয়মেই তার সন্তানকে গড়ে তুলবে। আধুনিক যুগে প্যারেন্টিং একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির বিস্তার, সামাজিক পরিবর্তন এবং কর্মজীবনের ব্যস্ততা শিশুর লালন-পালনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। তাই অভিভাবকদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে এবং শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।

সঠিক প্যারেন্টিং বনাম দুর্বল প্যারেন্টিং:

সঠিক প্যারেন্টিং হলো সন্তানকে বড় করে গড়ে তুলতে ও দিকনির্দেশনা দিতে একজন অভিভাবক সদা সচেষ্ট থাকেন। আর দুর্বল প্যারেন্টিং হলো, এর ঠিক উল্টো দিক। এর ফলে অভিভাবকের সঙ্গে সন্তানের মানসিক দূরত্ব থাকে অনেক বেশি। সন্তানের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঘাটতি থাকে সর্বাধিক। আর এই দুর্বল প্যারেন্টিং এর জন্য সন্তান বখে যাওয়া থেকে শুরু করে অজান্তেই নানা ভাবে নিজের ক্ষতি করে। সঙ্গ দোষে সন্তানটি মাদকাসক্ত হতে পারে, কিশোর গ্যাং এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, পড়ালেখায় অমনোযোগীতা ও দুর্বল হয়ে পড়ে, ঠিক মতো স্কুল ও কোচিং এর না যাওয়া থেকে শুরু করে নানাবিধ নেগেটিভ বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে সে যুক্ত করতে পারে। আর এ সবই হতে পারে, যখন অভিভাবক তার সন্তানের প্রতি প্রপার মনোযোগী না হন।

দুর্বল প্যারেন্টিং ও আগামী প্রজন্ম:

প্রযুক্তি আমাদেরকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ- এ কথাটি বর্তমানে বহুল প্রচলিত। কথাটির সত্যতা অনেকাংশেই সঠিক। কারণ এখন প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কারণে পিতা-মাতার পাশাপাশি তাদের সন্তাররাও কমপিউটার, ইন্টারনেট, গেমস ও মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্ক আগের মতো থাকছে না। সবাই নিজের মতো লাইফ লিড করছে। একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসে খাওয়া ও আলাপচারিতার বিষয়টি শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামেও এখন অনেক কমে গেছে। ফলে সন্তান নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা অভিভাবকের কাছে গোপন করছে, বরং যার কাছে পরামর্শ নিচ্ছে সে হয়তো সেই পরামর্শ দেবার উপযুক্তই নয়। বরং উল্টো পরামর্শ দিয়ে শিশুটিকে সে বিপথে নিয়ে যেতে পারে।

আমাদের দেশে সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়ের একটি অলিখিত দূরত্ব থাকে। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ইদানিংকালে কিছু কিছু পরিবারে মধ্যে দেখা গেলেও আদতে সেই সন্তান যখন কিশোর বা কিশোরী বয়সে উপনীত হয় তখন তার কাছের মানুষ হয় তার কোন বন্ধু বা বান্ধবী। এই বন্ধু/ বান্ধবী তাকে অনেক সময় মিসগাইড করতে পারে। আর এই ব্যাপারটিই অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে।

আবারো আসা যাক কিশোরী আরাবি ইসলাম সুবার প্রসঙ্গে। মেয়েটি তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে বাবার অজান্তেই চলে যাওয়াতেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা গণমাধ্যমগুলো সূত্রে জানতে পেরেছি। এটিও জানা যায় যে, মেয়ের মা ক্যান্সারের আক্রান্ত হওয়ায় দুই মাস পূর্বে তার পরিবার ঢাকায় শিফট করে। এতে বোঝা যাচ্ছে, পরিবারের একজন প্রধান সদস্যের শারীরিক অসুস্থতার কারণে সুবা সকলের এটেনশনই কম পেয়েছে। ফলে সে কিশোরী বয়সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক যদি বন্ধুত্বপূর্ণ হতো তবে এই জাতীয় ভুল করার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কম থাকে। কারণ জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে বোঝার ক্ষমতা কিশোরী সুবার নেই। তাকে হয়তো সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত গাইডও করা হয়নি।

তাহলে উপায় কি?

ভালো প্যারেন্টিংই হলো একমাত্র উপায়। এজন্য আপনার সন্তানকে বই পড়তে উৎসাহিত করুন, পারিবারিক সময় বাড়ান এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে (কমপিউটার, ইন্টারনেট, গেমস ও মোবাইল প্রভৃতি) নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন। কঠোরতা নয়, সহমর্মিতার মাধ্যমে তাকে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতির দিকটি বোঝান। কঠোর হলে সন্তান বেঁকে বসে নিষেধ করা কাজই বার বার করবে। এর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় সন্তানের স্ঙসঙ্গে কাটান। ছুটির দিনে পারিবারিক সময় বের করে পরিকল্পনা করুন। কোথাও সকলে মিলে মাঝে মাঝেই ঘুরতে যান। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানের প্রতি মনোযোগ দিন।

যেসব শিশু একটু একরোখা তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন। পর্যাপ্ত মানসিক সমর্থন প্রদান করুন এবং প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করান। সর্বোপরি সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিন এবং তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে সাহায্য করুন।

শেষ কথা হলো, প্যারেন্টিং কোনো নির্দিষ্ট নিয়মে চলে না; এটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া। তবে একটি ভালো পরিবারিক পরিবেশ, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, ধৈর্য ও ভালোবাসার মাধ্যমে শিশুকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সঠিক প্যারেন্টিং কেবল শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য নয়, বরং একটি সুস্থ সমাজ ও জাতি গঠনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করা, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম একটি নৈতিক, আত্মবিশ্বাসী এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও নৃবিজ্ঞানী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *