বুধবার, এপ্রিল ২৩Dedicate To Right News
Shadow

ধারাবাহিক গল্প “রহস্যময় আয়না” [১ম পর্ব]

Spread the love
  • রেজাউর রহমান রিজভী

অকশন থেকে বেশ শখ করেই ড্রেসিং টেবিলটা কিনেছেন আকমল চৌধুরী। উদ্দেশ্য একমাত্র মেয়ে মিতুকে জন্মদিনের গিফট হিসেবে এটা দেবেন। প্রাচীন কোনো এক রাজার স্ত্রী নাকি এই ড্রেসিং টেবিলটা ব্যবহার করতেন। আকমল চৌধুরী এটা বেশ ভালো করেই জানেন যে, অকশনে প্রায়শঃই সব কিছু বাড়িয়ে বলা হয়। কোন কোন সময় অবশ্য এসব কথার সত্যতাও কিছুটা পাওয়া যায়। তবে সাধারণত নিলামে কোন জিনিসের মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যই যেখানে মূখ্য, সেখানে মাঝে-মধ্যে এসব বাড়িয়ে বলাটাকেও তো মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নাই।
বাড়িতে ড্রেসিং টেবিল আরো দুটো আছে। কিন্তু এই ড্রেসিং টেবিলটা যেন সবগুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার চারপাশে খুব সুন্দর করে কাঠের খোদায় করা নকশা। আয়নার শেইপটাও বেশ দারুণ। রাউন্ড শেপ।
এখন তো প্রায় সব ড্রেসিং টেবিলই হয় লম্বাটে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু মানুষ কি তার পা দেখতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়? নিজের চেহারা দেখাই তো মূল উদ্দেশ্য থাকে। আকমল চৌধুরী নিজেও তো আয়নার সামনে যান কেবল চুল আঁচরাতে। অবশ্য মেয়েরা জামা পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেকে দেখে কেমন লাগছে। এজন্যই হয়তো অধিকাংশ ড্রেসিং টেবিলের আয়নাই লম্বা হয়।
তবে নতুন কেনা ড্রেসিং টেবিলটার আয়নাটা রাউন্ড শেপ হলেও বেশ বড়। ফলে পা থেকে মাথা অবধি দেখা যায়। এজন্য তিনি আশা করছেন মিতুর এটা পছন্দ হবে।
মেয়েকে গিফট করতে কোন দিবস লাগবে সেটাতে তিনি বিশ^াসী নন। এজন্য দেখা যায়, হয়তো মেয়ের জন্মদিনে কিছুই দিলেন না। কিন্তু হুট করে অন্য সময় বেশ দামি একটা গিফট দিলেন। বাসার সবাই আকমল চৌধুরীর এই খামখেয়ালীর কথা জানে। তাই কেউ কিছু মনে করে না।
২.
এবার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে মিতু। বরাবরই ছাত্রী হিসেবে বেশ ভালো সে। এজন্য আকমল চৌধুরী বেশ গর্বিতও বোধ করেন।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে মিতু। বিশ^বিদ্যালয়ে নিজে পছন্দ করে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েছে। লক্ষ্য একটা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। এজন্য ভর্তির পর থেকেই মেয়েকে রাত জেগে পড়তে দেখেন আকমল চৌধুরী। পড়াশোনা নিয়ে আকমল চৌধুরীর কখনোই কোন মাথাব্যথা নেই। তার একটাই কথা, ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করবে নিজেদের ইচ্ছায়, আনন্দে। তাতে চাপাচাপি করলে হিতে-বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই কেবল বাড়ে।
আর একারণেই মিতু আর মিতুর ছোট ভাই আকিবের কাছে সেরা বাবা আকমল চৌধুরী। অপর দিকে মিতুর ঠিক বিপরীত হলো আকিব। আকিবের পড়তে ভালো লাগে না। সেজন্য যথারীতি ফেলও করে। কিন্তু বাবার কাছে ওর মা শাহানা চৌধুরী যখনই ছেলের সম্পর্কে বিচার দেন, আকমল চৌধুরী নির্বিকার থাকেন। অন্যদিকে মেয়ে দুর্দান্ত ফলাফল করার সংবাদ জানতে পারলেও তিনি নির্বিকারই থাকেন। আর এ বিষয়টির জন্য আকমল চৌধুরীর উপর বেশ বিরক্ত শাহানা চৌধুরী। তবে মিতু-আকিব দুই ভাই- বোনই বাবার উপর বেজায় খুশি।
৩.
আকমল চৌধুরী ড্রেসিং টেবিলটা নিয়ে বাসায় আসার পর মোটামুটি হুলুস্থুল পড়ে গেল। পুরো মহল্লাতে রটে গেল আকমল চৌধুরী প্রচুর টাকা খরচ করে পুরাতন একটা ড্রেসিং টেবিল কিনে এনেছেন। এটা নিয়ে কেউ কেউ বা গবেষণাও শুরু করে দিলো। দু-একজন তো বলেই বসলেন নিশ্চয় ড্রেসিং টেবিলের ভেতরে কোথাও গোপন কোন ম্যাপ আছে। যেটি ধরে খুঁজলে হয়তো গুপ্তধন পাওয়া যাবে। কারো কারো কাছে তিনি হাসির পাত্রও হলেন।
আকমল চৌধুরীর স্ত্রী শাহানা চৌধুরীও বিরক্তদের দলে নাম লেখালেন। ঘরে দুইটা ড্রেসিং টেবিল থাকার পরও কেন পুরনো আরেকটা কিনে আনতে হবে সেটাই তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে এতো জনের ভীড়ে তার মেয়ে মিতুই কেবল খুব খুশি হলো। মেয়ের খুশি দেখে আকমল চৌধুরী বাকি সবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কথা ভুলে গেলেন। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিলেন যে, যার জন্য এটা কেনা সে খুশি হলেই হবে। বাকিদের কথার দাম না দিলেও হবে।
অকশনের গুরুত্ব মিতু বোঝে। আর তাই পুরনো একটা ড্রেসিং টেবিল পেয়েও সে খুব খুশি। ফেসবুকে সেলফি দিয়ে ক্যাপশনে লিখে দেয়, ‘মাই নিউ ড্রেসিং টেবিল ফ্রম অকশন’। মিতুর বন্ধুরা কমেন্টে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো। কোন আমলের ড্রেসিং টেবিল এটা, কোন রাণী ব্যবহার করতো, এসব প্রশ্নের ভীড়ে মিতুর ফেসবুকের কমেন্ট ঘরগুলো ভরে উঠতে থাকে। বাবাকে মিতু সেসব কমেন্ট পড়ে শোনায়। আকমল চৌধুরী তৃপ্তবোধ করেন।
৪.
রাত জেগে পড়াটা মিতুর ছোটবেলার অভ্যাস। রাত যত গভীর হয়, ততই যেন মিতুর মাথা খুলতে শুরু করে। মা সব সময়ই বলেন সকালে উঠে পড়তে। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম দুই ঘন্টা মিতুর মাথা একেবারেই কাজ করে না। কেমন যেন ঝিম মেরে থাকে। বরং সকালে পড়ার বদলে রাত গভীর হলেও কোন সমস্যা নাই। যত কঠিন চ্যাপ্টারই হোক না কেন, আয়ত্বে আসবেই।
মিতুর রাত জেগে পড়ার ব্যাপারটি বাসার সবাই জানে। আকমল চৌধুরীরও কড়া নির্দেশ, যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই মেয়ে পড়বে। তাই এখন আর কেউ ওকে সকালে ঘুম থেকে ডেকে উঠিয়ে পড়তে বসায় না।
৫.
রোজকার মতো আজ রাতেও পড়তে বসেছে মিতু। ঘড়ির কাঁটায় ২টা বাজার সংকেত পড়লো। নতুন কেনা ড্রেসিং টেবিলটা মিতুর পড়ার টেবিলের পাশেই রেখেছে। মিতু পড়ছে আর মাঝে মাঝে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকাচ্ছে। আকমল চৌধুরীর অনেক কিছুই অনেকের পছন্দ না হলেও মিতুর কাছে এবার তার পছন্দে কেনা ড্রেসিং টেবিলটা খুবই দারুণ লেগেছে।
ইউনিভার্সিটিতে নতুন আসা রেহান কবির স্যার ভিন্ন একটা টপিক পড়ে আসতে বলেছেন কাল। রাত জেগে সেটাই পড়ছে মিতু। সেক্সপিয়ারের ট্রিওলজি উপন্যাসগুলো সম্পর্কে পড়ে যেতে হবে। প্রাথমিক ভাবে এটাকে স্যার টিউটোরিয়াল হিসেবেও নাকি কাউন্ট করতে পারেন। তাই বেশ সিরিয়াসলিই মিতু পড়ছে।
সেক্সপিয়ারের জীবনের অনবদ্য উপন্যাস ত্রয়ী ‘থিংস ফল এপার্ট’, ‘নো লংগার অ্যাট এজ’ ও ‘অ্যারো অফ গড’ কে একত্রে ট্রিওলজি হিসেবে বলা হয়। তিনটি উপন্যাসের প্রথম দুটি আগেই পড়া হলেও তৃতীয়টি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করেছে আজ। এটি শেষ হলে প্রথম দুটি একবার করে হলেও অন্তত পড়তে হবে। মিতু জানে ওর মতো কেউই সম্পূর্ণ উপন্যাস পড়ে যাবে না। অধিকাংশই বড়জোর উপন্যাস তিনটির সারসংক্ষেপ পড়ে যাবে। কিন্তু মিতু অসম্পূর্ণ কোন কিছুর পক্ষপাতি কোন কালেই ছিল না। সারসংক্ষেপ থেকে একটি উপন্যাসের সম্পর্কে হয়তো কিঞ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু লেখকের ডিটেইলস ভাবনাটা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
৬.
‘অ্যারো অফ গড’ বইটির মোটামুটি অর্ধেক শেষ করেছে এমন সময় মিতুর বেশ পানি তৃষ্ণা পেল। ডাইনিং রুমে গিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসে পানি ভরে নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো মিতু। প্রতিদিন রাতে পড়ার সময় মিতু নিজের টেবিলে সব সময় পানির একটা বোতল রাখে। আজ মনের ভুলে বোতলে পানি ভরতে ভুলে গেছে।
রুমে ঢুকেই মিতুর কাছে মনে হলো, ও ছাড়াও রুমে আরো যেন কেউ আছে। মিতুর ঘরে আড়াল করার মতো কোন জায়গা নেই। ঘরের দরজা থেকেই পুরো ঘর এক নজরে দেখে নেয়া যায়। বক্স খাট হওয়ায় খাটের নিচেও যে কেউ লুকাবে সে অবস্থাও নেই। তাহলে এই গভীর রাতে কে থাকবে ওর ঘরে?
চোর?
নাহ, সেটাও সম্ভব না।
তাহলে কি অশরীরি কোন কিছু?
এটা ভাবতেই ভয়ে মিতুর গায়ের লোপ দাঁড়িয়ে গেল। আস্তে আস্তে সাহস সঞ্চয় করে নিজের চেয়ারে বসলো সে। ঘরের লাইট জ¦ালানোই ছিল। কিছুক্ষণ পর মিতু ভাবলো যে, লাইট জ¦লা অবস্থাতেও সে ভূতের ভয় পেয়েছে এ কথা তো কাউকেই বলা যাবে। আসলে মা ঠিকই বলে। দিনকে দিন ও আসলেই একটা ভীতুর ডিম হয়ে যাচ্ছে।
ঘড়িতে ৪টা বাজার সংকেত দিলো। মিতুর বেশ ঘুম পাচ্ছে। কোন মতেই চোখ দুটো তাকিয়ে থাকতে পারছে না। আসলে আগের রাতে ঘুম খুব কম হয়েছে বলেই এখন এই সমস্যা হচ্ছে। হাই তুলতে তুলতে মিতুর চোখ ড্রেসিং টেবিলের দিকে গেল। যা দেখলো তাতে নিজের চোখকেও বিশ^াস করতে কষ্ট হলো। এক নিমেষে মিতুর ঘুম কোথায় যেন ছুটে গেল। কি যেন এক অজানা আকর্ষণে মিতুর চোখ ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে চুম্বুকের মতো আটকে থাকলো।
ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটাকে মিতুর কাছে টেলিভিশনের পর্দা বলে মনে হতো লাগলো। যেন পুরনো দিনের সাদাকালো কোন সিনেমা দেখছে সে।
আয়নায় মিতু দেখতে পেল অপূর্ব সুন্দরী এক তরুণী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। পেছনে উদ্যত তরবারি হাতে নাক-মুখ কালো কাপড়ে বাঁধা এক ঘাতক। ধীরে ধীরে তরবারি নেমে আসছে তরুণীর ঘাড় বরাবর। নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠতে চাইলো। কিন্তু খেয়াল করলো ওর কণ্ঠ দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছে না। ও যেন পুরোই নিশ্চল। সময়ও কেমন যেন থমকে গেছে। ঘাতকের তরবারির কোঁপে তরুণীর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়ে গেল। কাটা মাথা মিতুর পায়ের কাছে ছিটকে পড়লো। এবার মিতু সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো।

চলবে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *