শনিবার, মে ১৭Dedicate To Right News
Shadow

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ

Spread the love
  • লিটন আব্বাস
শিলাইদহের কুঠিবাড়ী ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের নামে ক্রয় করেন ঠাকুরবাড়ীর জমিদারী। এরপরের ইতিহাস কমবেশী অনেকের জানা।
রবীন্দ্রনাথ ‘ছিন্নপত্রে’ ১৮৭১ ক্রিস্টাব্দে তাঁর দাদার সাথে রেলগাড়ীতে চড়ে প্রথমে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহে আসার কথা উল্লেখ করেছেন এবং ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে শিলাইদহের জমিদারী ভার গ্রহণ করেন। ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি নগরী কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মাটিতে রবীন্দ্রনাথের পূর্বাপর জমিদারী সূত্রে প্রথম শিলাইদহে আসলেও চারণভূমি হিসেবে পরবর্তীতে ১৮৮৯ থেকে টানা ১০-১২ বছর এবং পরবর্তীতে ১৯১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২১-১৯২২ খ্রিস্টাব্দ্ওে শিলাইদহের মাটির জনসংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে বসবাস করে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। রবি ঠাকুর ৪৫ বছর ধরে শিলাইদহে যাতায়াত করেছেন এবং সপরিবারে ১২ বছর বসবাস করেছেন।
এই মাটিতে বসে ‘সোনারতরী’ ‘চিত্রা’ চৈতালী’, ‘কল্পনা’, ‘কণিকা’, ‘কাহিনী’, ‘ক্ষণিকা’, ‘খেয়া’, ‘নৈবেদ্য’ এবং বলাকা কাব্যগ্রন্থের বহু মূল্যবান কবিতা ও উপন্যাস ‘চোখের বালি’, ‘গোরা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘ঘরেবাইরে’ তাছাড়া ১০টি গল্পগুচ্ছ, গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গান ‘গীতিমাল্য, ‘গীতবিতান’ নাটক ‘গোড়ায় গলদ’, ‘ চিরকুমার সভা’, ‘চিত্রাঙ্গদা, ‘রাজা অচলায়তন’, প্রবন্ধ ‘পঞ্চভূত’, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ পত্রাবলীঃ ‘যূরোপ যাত্রীর ডায়েরী’, ভানু সিংহ ঠাকুরের পত্রাবলী ছিন্নপত্র’, জীবনীঃ জীবন স্মৃতি’ রচনা করেন। এই মাটির বাউল কবি বাউল সম্রাট লালন শাহ, গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ সহ নাম না জানা বাউল কবিদের সংস্পর্শে কবি সত্যিকার অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কে জ্ঞাত হলেন। সে জন্য তিনি নিজেই বলেন,“ আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনেক গানে আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি।”
তাইতো কবি গুরু শিলাইদহের পদ্মার তীরে বাউল সাধকদের একতারা হাতে চলার দৃশ্য অমর করে রেখেছেন তার কবিতায়ঃ
‘কতদিন দেখেছি ওদের সাধককে
একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মা নদীর ধারে।
যে নদীর নেই কোন দ্বিধা
পাকা দেউলের পুরাতন ভিত ভেঙ্গে ফেলতে
দেখেছি একতারা হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে
মনের মানুষকে সন্ধান করবার
গভীর নির্জন পথে।’
“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” শিলাইদহ ডাকঘরের পিয়ন গগণ হরকরার “আমি কোথায় পাবো তারে-আমার মনের মানুষ যেরে” গানের সুরে রচিত। এছাড়া বাউল বাতাসের স্পর্শে আরো অনেক বিখ্যাত লেখা “ও আমার দেশের মাটি” “যদি তোর ডাক না শুনে কেউ না আসে”, ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস’, ‘মেঘের কোলে কোলে’, ‘মালা হাতে খসে পড়া’, ‘আমি যখন ছিলাম অন্ধ’, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, ‘ডাকব না ডাকব না’, ‘হে আকাশ-বিহারী নীরদ-বাহন জল’, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘আমি তখন ছিলেন মগণ’, ‘আমার প্রাণের সুধা আছে’, ‘আমার নাই বা হল পারে যাওয়া’ ইত্যাদি সহ অসংখ্য দুর্লভ গান। তাইতো কবি এ অঞ্চলের লোকসংসস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নির্বিঘে বলেন‘‘ আমি কিছুদিন যাবৎ একটা বিষয়ে বড়ই উদ্বিগ্ন বোধ করিতেছি; বাংলার নিজস্ব আর্ট আইডিয়া ক্রমেই বিদেশী প্রভাবে নষ্ট হইয়া যাইতেছে, আর কিছুদিন পর আমাদের খাঁটি দেশীয় শিল্পের নিদর্শন লোপ পাইবে। তাই আমি এই সকল নমুনা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি।”
অরূপ রূপের অধিকারী শিলাইদহ জীবনে রবীন্দ্রনাথ জমিদারীর উন্নয়নে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কেমন করে পল্লী ছেলে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠতে পারে তা তিনি নিজে অগ্রণী হয়ে শিলাইদহে করেছেন। এই অঞ্চলে প্রথম গোল আলুর চাষ তিনিই শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন প্রদেশ থেকে উন্নত ধান বীজ এনে কৃষকদের মাঝে বিতরণ, গুটি পোকার চাষ প্রভৃতি করেছেন। কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে কৃষকদের স্বাবলম্বী করতে চেয়েছিলেন। সাহিত্য সাধনা ও বিষয় সম্মতির অন্তরালে অবসরে কবি শিলাইদহ পল্লীর মানুষগুলোর কথা গভীরভাবে ভাবতেন।
‘‘আমার এই দরিদ্র চাষী প্রজাগুলোক দেখলে আমার ভারী মায়া করে। এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরূপায়। তিনি এদের মুখে নিজে হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে, কোনমতে, একটুখানি ক্ষুধা ভাঙ্গলেই আবার তখনই সমস্ত ভুলে যায়।”
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ কুঠিবাড়িকে ঘিরে কাচারীবাড়ি, বিট্রিশভারতের তৎকালীন নদীয়া জেলার সর্ববৃহৎ দাতব্য চিকিৎসালয় সহ টেগর লজও গড়েছিলেন এই মাটিতে ।
কবি যখন গুরু শেষবার শিলাইদহ ঘুরে গেলেন। তিনি উৎকুণ্ঠিত চিত্তে বললেনঃ “ শিলাইদহ ঘুরে এলুম। পদ্মা তাকে পরিত্যাগ করেছে, তাই মনে হল বীণা আছে তার নেই, তার না থাকুক অনেক কালের অনেক গানের স্মৃতি আছে। ভাল লাগলো, সেই সঙ্গে মনকে মন উদাস হলো।’’
কোনক্রমেই বিশ্বকবি শিলাইদহের এ মাটির জনসংস্কৃতি থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাননি বলে অন্তিম প্রয়াণে তার শেষ উক্তি ছিল-‘‘আরেকবার শিলাইদহ গেলে…’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *