
বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখায় বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকার ভাতা প্রদান, সারা দেশে শিল্পায়ন সম্প্রসারণ, মিল-কারখানা স্থাপন এবং পরিকল্পিতভাবে শিল্প অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। তবে এসব বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি, যথাযথ নীতিকাঠামো, সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস এবং তথ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা। স্বচ্ছতা ও প্রোডাকটিভিটি বাড়াতে বিশ্বমানের প্রযুক্তির অনুসরণ করতে হবে।
শুক্রবার চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী রোডের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে “কর্মসংস্থান ও বহুমাত্রিক শিল্পায়ন: তারুণ্যের ভাবনা” শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেমিনারটি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়নে তরুণ সমাজকে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আয়োজিত এক মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হয়। যৌথভাবে জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল এই সেমিনারের আয়োজন করে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যে জাতি টেকনোলজিতে পিছিয়ে থাকবে, তারা কখনো সামনে যেতে পারবে না—তা সে কৃষি, সেবা, উৎপাদন কিংবা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেই হোক। যদি স্বচ্ছতা আনতে চান, প্রোডাকটিভিটি বাড়াতে চান, যদি কম্পিটিটিভ হতে চান—তবে প্রযুক্তির বিশ্বমান অনুসরণ করতেই হবে।
তিনি বলেন, “যেভাবে জিয়াউর রহমান গার্মেন্টস সেক্টরের পথ উন্মোচন করেছিলেন, তেমনি আমরা ১০–১৫টি সেক্টরে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দেব। এটি একটি বিশাল ইনসেনটিভ হবে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সরকারি আমলাদের কাছে যেতে হবে না। কেউ চাইলে বাড়িতে বসে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, “বিএনপি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যেখানে বিএনপির বাইরের মানুষও এসে কঠিন সত্য তুলে ধরছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অভিনব দৃষ্টান্ত।”
কর্নেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার জামাল উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে দেশে বেকারত্ব নিরূপণে একটি জাতীয় ও সমন্বিত ডেটাবেইজ তৈরি করা জরুরি। বর্তমানে যে ৪ শতাংশ বেকারত্বের তথ্য রয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের একটি কমপ্রিহেনসিভ ডেটা দরকার, যেখানে বোঝা যাবে—কোন জেলায় কতজন বেকার, কোন শিক্ষাগত যোগ্যতায় বেকারত্ব বেশি। এতে ইন্টারভেনশন সহজ হবে এবং সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর নীতি প্রণয়ন করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির ৩১ দফার বিভিন্ন অংশে কর্মসংস্থান ও শিল্পায়ন নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এখন সময় এসেছে বাস্তবভিত্তিক, ফলপ্রসূ ও সময়োপযোগী একটি নীতি প্রণয়নের, যাতে আগামী ১০–১৫ বছর পর দেশের তরুণ প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করতে পারে।
”যেমন জিয়াউর রহমান অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণের যাত্রা শুরু করে দেশের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব ফল দিয়েছেন, তেমনি বিএনপির উচিত এখন এমন আধুনিক নীতি গ্রহণ, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে।”
পাঠাও-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ বলেন, আমাদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রসেসে আপস্কিলিং, ভোকেশনাল ট্রেনিং এবং নির্দিষ্ট দক্ষতার ভিত্তিতে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল ইকোনমির বিকাশে লাইসেন্সিং কমিয়ে ডিরেগুলেশন করতে হবে এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমাদের একটি আইনভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বোধ করবেন।
ফাহিম আহমেদ সতর্ক করে বলেন, একটি অন্তর্বর্তী সময় বা অনিশ্চয়তা বিরাজ করলে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। তাই স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য একটি নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
তিনি আরো বলেন, দেশের মানুষ এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি থেকে সদ্য বেরিয়ে এসেছি। এখন সময় এসেছে আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে যুবসমাজ, পেশাজীবী, উদ্যোক্তা ও শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করেই আমাদের এই পথচলা শুরু করতে হবে।
সেন্ট্রিস্ট নেশন টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা শাফকাত রাব্বী বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এক ধরনের ‘ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন’-এর মধ্য দিয়ে যাবে। অনেক চাকরি হারিয়ে যাবে, আবার অনেক নতুন চাকরির জন্ম হবে।
তিনি বলেন, এই অনিশ্চয়তার সময়ে তরুণদের কোন কোন স্কিলের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত সেই বিষয়ে আলোকপাত করেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মাবরুর রশিদ বান্নাহ বলেন, ভবিষ্যতে যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তাহলে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের অফিস বাংলাদেশে স্থাপনের জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তিনি তারেক রহমানকে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরুধ জানান।
জনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, আমাদের বিসিএস-এর প্রতি যে অন্ধ মোহ, তা থেকে সরে আসা উচিত। যারা বিসিএস-এর জন্য প্রস্তুতি নেয়, তাদের অনেকেই দুর্বল দক্ষতার অধিকারী এবং অন্য কোথাও চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এই মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা জীবনের দশটি বছর নষ্ট করে ফেলি।
তিনি বিসিএস ভাইভার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অর্থনীতি, কম্পিউটার সায়েন্স, রাষ্ট্রবিজ্ঞান—সব বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানের ঘাটতি চোখে পড়ে।
তিনি বলেন, দেশের তরুণদের বাস্তব দক্ষতা খুবই কম, ইংরেজিতে দুর্বলতা প্রকট। ‘আমরা শেখ হাসিনার আমলে পড়েছি’—এই অজুহাতে নিজেদের অক্ষমতা ঢেকে রাখা চলবে না। আমরা এমন একটি পরিবেশ চাই, যেখান থেকে দক্ষ তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদি আমিন এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দেন।
তিনি বলেন, “এই অনুষ্ঠানটি আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিএনপির বাইরের শিল্প বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করা, যাতে তারা আমাদের নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারেন। আমরা সেরা মানুষের কাছ থেকে শুনতে চাই এবং যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে দেশের জন্য সর্বোত্তম নীতি প্রণয়ন করতে চাই।”