- রেজাউর রহমান রিজভী
মানুষ সর্বদা পরিবর্তন পছন্দ করে। নতুন নতুন জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হতে পছন্দ করে। ফলে কিছু ভালো, সঙ্গে কিছু মন্দ জিনিসও এ পরিবর্তনের তালিকায় ঢুকে পড়ে। ই-সিগারেট তেমনই একটি নতুন ও আকর্ষণীয় জিনিসের নাম। অথচ এর কোনো উপকার তো নেই-ই, বরং অপকারের জন্য পৃথিবীর ৪১টিরও বেশি দেশ- এটিকে এরই মধ্যে নিষিদ্ধ করেছে। অথচ আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে ই-সিগারেট বিক্রির ব্যাপকতা এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটি অনলাইনে বিভিন্ন ই-কমার্সের সাইটসহ দোকানগুলোতে অবাধে বিক্রি ও প্রদর্শন করা হচ্ছে। ফলে ই-সিগারেটের অপরিণামদর্শী আকর্ষণে যুবসমাজ আকৃষ্ট হয়ে সহজেই ই-সিগারেট কিনতে ও ব্যবহার করতে পারছে। নির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণেই মূলত এ ব্যাপারটি হচ্ছে। পুরো বিষয়টি আলোচনার আগে দেখা যাক- ই-সিগারেট আসলে কি এবং এটি কীভাবে ক্ষতি করে।
ই-সিগারেট হলো ব্যাটারি দ্বারা চালিত ডিভাইস যা দেখতে অনেকটা সিগারেটের মতোই। যদিও এতে তামাক থাকে না, তবে যথেষ্ট পরিমাণ নিকোটিন জাতীয় উপাদান থাকে। অবশ্য আধুনিক যুগে ই-সিগারেটের মধ্যে ভ্যাপ মডস, জুলস, ভ্যাপ পেনস অন্তর্ভুক্ত। অনেকের মধ্যেই একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, এই ধরনের সিগারেটে প্রচলিত সিগারেটের মতো এত বেশি নিকোটিন থাকে না।
আবার সিগারেটের প্রতি আসক্তি কমাতে চাইলে এই ব্যাটারিচালিত সিগারেট ভূমিকা রাখে বলে অনেকে ধারণা করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে যে ই-সিগারেটে যে পরিমাণ নেশা সৃষ্টিকারী পদার্থ নিকোটিন থাকে তা এর প্রতি আসক্তি সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। আর যদি কেউ ই-সিগারেটের মাধ্যমেই ধূমপান শুরু করে তাহলে ওই ব্যক্তির ভবিষ্যতে ধূমপানের প্রতি আরও বেশি আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর কারণ একটু পরে আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আসলে ই-সিগারেটের মতো ইলেকট্রনিক প্রোডাক্ট নিকোটিন গ্রহণে সহায়তা করে। এটি নিকোটিন, সুগন্ধি এবং অন্যান্য উপাদানে ভরা তরল কার্তুজকে তাপ দিয়ে ধূমপান করতে সহায়তা করে। যেহেতু এই ই-সিগারেটে তামাকের বদলে তরল পদার্থ থাকে সেহেতু এ ধরনের সিগারেটে কোনো ধোঁয়া সৃষ্টি হয় না বলেই ধরা হয়।
ই-সিগারেটের প্রতি যুবসমাজের আসক্তি কেন বাড়ছে?
আসলে ই-সিগারেট এমন মানুষদেরও ধূমপানে উদ্বুদ্ধ করছে, যারা হয়তো কখনও ধূমপান করা সম্পর্কে ভাবতও না। এর একটি কারণ হলো সাধারণ বা প্রচলিত সিগারেটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানির প্রোডাক্ট হলেও ঘুরে ফিরে তামাকে মুড়ে দেওয়া সিগারেটই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সিগারেটে যেমন আকারের ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিকল্প, তেমন ফ্লেভার বা স্বাদের ক্ষেত্রেও কিছুটা স্বাধীনতা পাবে ধূমপায়ীরা। আর একবার এই সিগারেটে পারদর্শী হয়ে গেলে প্রচলিত সিগারেট ব্যবহার করে দেখার ইচ্ছা জাগা স্বাভাবিক বিষয়ই বলা যায়। ইলেকট্রনিক সিগারেট বিভিন্ন ফলের স্বাদযুক্ত পাওয়া যায়।
গবেষকদের মতে, নিকোটিনের সঙ্গে চিনি বা মিষ্টি জাতীয় উপাদানের সংযোগ এ ধরনের সিগারেটের প্রতি আসক্তিকে বেশি দৃঢ় করে। এটা এই প্রোডাক্টের আসক্তি-সৃষ্টিকারী একটি বিশেষ গুণ। হঠাৎ করে ই-সিগারেটের চাহিদা বাড়ার পেছনে বিভিন্ন ফ্লেভার বা স্বাদের হওয়া যেমন একটি বড় কারণ, তেমন মিষ্টির সংযোগে আরও বেশি নেশা-সৃষ্টিকারী দ্রব্য তৈরি করা সুদূর ভবিষ্যতে এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী।
গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভর্নেন্স ইন টোবাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি) তথ্য অনুসারে পৃথিবীর ৪১টি দেশ ই-সিগারেট বিক্রয় ও বিতরণ নিষিদ্ধ করেছে।
গবেষণায় দেখা যায় যে, অপ্রাপ্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানকারীরা নিকোটিনযুক্ত সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ফ্লেভার বা স্বাদযুক্ত ইলেকট্রনিক সিগারেটই বেশি পছন্দ করে। আবার ই-সিগারেট ফ্লেভার ছাড়া হলে তা ধূমপানকারীরা ব্যবহার করতে চায় না। আর দুঃখের বিষয় হলো এই ফ্লেভারই ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লেভারযুক্ত সিগারেট নিষিদ্ধ করা হলেও এর প্রভাব ই-সিগারেটে পড়েনি, কারণ তামাকবিহীন এই প্রোডাক্ট সিগারেটের পর্যায়ে পড়ে না। জুলের কাছে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলা হয় যে, কোম্পানিটি ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এর সঙ্গে একত্রিত হয়ে তরুণ সমাজের সিগারেটের প্রতি আসক্তি কমানোর কাজ করছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা।
ই-সিগারেটের কুফল
ই-সিগারেটে থাকা কেমিক্যাল, তেল, ফ্লেভার এবং নিকোটিন তাপের সংস্পর্শে এলে অ্যারোসল সৃষ্টি করে। এ থেকে সৃষ্ট সূক্ষ্ম কণাগুলো আকারে তামাক কণার মতোই, যা ফুসফুস পর্যন্তু পৌঁছাতে পারে। এসব সিগারেটের বেশিরভাগ কেমিক্যালই কোষের জন্য বিষাক্ত। অবশ্য এর প্রভাব কতটুকু ক্ষতিকর তা বোঝা কষ্টকর। কারণ প্রত্যেকটি সিগারেটের কেমিক্যালের মিশ্রণ এবং গঠন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। সুগন্ধি বা ফ্লেভারযুক্ত সিগারেট ধূমপানে ব্যবহার করা তামাক জাতীয় সিগারেটের চেয়ে কম নিকোটিনযুক্ত হতে পারে। কিন্তু এসব সুগন্ধির জন্য ব্যবহৃত কেমিক্যাল শ্বাসের সঙ্গে নেয়াটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ ই-সিগারেট ব্যবহার করলে তা বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও থাকে।
ই-সিগারেটে ব্যবহৃত তরল পদার্থটি শিশু ও বয়স্কদের চামড়ায় বা চোখে গেলে তা বিষের ন্যায় কাজ করতে পারে, যার ফল মৃত্যু পর্যন্তু গড়াতে পারে। প্রচলিত সিগারেটের মতোই এসব ই-সিগারেটও ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। গর্ভকালীন সময়ে ই-সিগারেট ব্যবহারে ক্ষতি হয়। এমনকি গর্ভপাতও ঘটতে পারে। আবার কিছু কিছু ই-সিগারেটে ফরমালডিহাইড থাকে। এর ফলে ব্যবহারকারীর বমি বমি ভাব কিংবা বমি হয়, মাথা ঘুরায়। নাক ও মুখেও বিভিন্ন ক্ষত ও সমস্যার সৃষ্টি করে।
এফডিএ এখনও ধূমপান কমানোর জন্য ই-সিগারেট ব্যবহারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাছাড়া ই-সিগারেট কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সাধারণ সিগারেটের মতোই ক্ষতিকর। কোনটা বেশি ক্ষতিকর কিংবা ই-সিগারেট ব্যবহার করা কতটুকু নিরাপদ তা এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তাই আপাতত ই-সিগারেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকাই ভালো।
বাংলাদেশে ই-সিগারেট বিক্রি
বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দোকান ছাড়াও অনলাইনের বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে ই-সিগারেট বিক্রি করা হচ্ছে। ডিসকাউন্ট দিয়ে, ক্যাশব্যাক অফার দিয়ে হরেক রকমের শত শত ধরনের ই-সিগারেট অনলাইনে বিক্রি ও প্রদর্শিত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডেলিভারী চার্জ কম রাখা বা ডেলিভারী ফ্রি দেয়ার মাধ্যমেও ই-সিগারেটের বিক্রি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কোন বয়সের বাধ্যবাধকতা না থাকায় যে কোন বয়সের মানুষই অনলাইন থেকে ই-সিগারেট কিনতে পারছেন। চটকদার সব বিজ্ঞাপন ও ভুল তথ্য দিয়ে ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করা হচ্ছে। ভুল ও চটকদার বিজ্ঞাপনের গোলাকধাঁধাঁয় অনেকেই ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছেন ও ই-সিগারেটের প্রতি আসক্ত হচ্ছেন।
ই-সিগারেট বিক্রি ও প্রদর্শনরোধে প্রয়োজন কঠোর আইন :
বাংলাদেশে আইনে এখন পর্যন্ত ই-সিগারেট বিক্রি ও প্রদর্শনরোধে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। আইন না থাকার কারণে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হওয়া সত্ত্বেও ই-সিগারেট বিক্রি ও প্রদর্শন হচ্ছে অবাধে। এক্ষেত্রে একমাত্র আইনই পারে ই-সিগারেটের বিক্রি ও প্রদর্শনরোধ করতে।
এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি সংশোধিত খসড়া আইন প্রণয়ন করেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত সাপেক্ষে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধিত খসড়া চূড়ান্ত করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খসড়া আইনের ৬ঙ ধারাতে বলা হয়েছে- ‘ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ইত্যাদি নিষিদ্ধ- (১) কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, উহার যন্ত্রাংশ বা অংশ বিশেষ (ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ইত্যাদি) হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্টস, হিট নট বার্ণ এবং ওরাল পাউচ যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার- প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন করবেন না বা করাবেন না।’
খসড়া আইনে ই-সিগারেটের এ ধারাটি অনুমোদন হলে দেশে ই-সিগারেটের ব্যবহার বন্ধ হবে ও তরুণ প্রজন্ম তামাক ব্যবহারজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবে।
সম্প্রতি আর তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ ই-সিগারেট বিক্রি, বিপণন ও প্রদর্শনরোধে খসড়া আইন অনুমোদন করে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে যতদ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নিন।