
তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার সম্ভাবনাময় নাট্যদল ‘তৈনগাঙ থিয়েটার’। পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের নাট্যঙ্গনে যুক্ত হলো আরও একটি নাম। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাঙ্গামাটিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট অডিটোরিয়ামে দলের প্রথম প্রযোজনা ‘মন’উকূলে’ এর মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাট্যদলটি আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এর চেয়ারম্যান বাবু অংসুই প্রু চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ এর সদস্য বাবু দিপ্তীময় তালুকদার, রাঙ্গামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জনাব ওমর ফারুক এবং অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট রাঙ্গামাটি এর পরিচালক বাবু রুনেল চাকমা। তঞ্চঙ্গ্যা নাটক-‘মন’উকূলে’ এর গল্পকার রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ছিলেন আশিক সুমন।
১৪ শতকের দিকে আরাকান রাজ্যের পর এ অঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর আদিনিবাস ‘তৈনগাঙ’ এর নামানুসারে থিয়েটার এর নামকরণ। ‘তৈনগাঙ থিয়েটার’ বিশ্বাস করে ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সৃষ্টি আর মানবিকতায়। সৃষ্টির আহ্বানে তারা প্রদীপ জ্বালাতে চায় মঞ্চে। আবহমানকালের মানুষের জীবনধারা বুনতে চায় থিয়েটার এর আদলে। জাতি দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে ধারণ করতে চায় সকল অনুভূতিকে। তাই প্রকৃতি আর মানুষকে আশ্রয় করে তাদের এই শৈল্পিক পদযাত্রা!
এ প্রসঙ্গে দলের সভাপতি রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “তৈনগাঙ থিয়েটার”পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্যময় সংস্কৃতিকে থিয়েটারের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চায়। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় থিয়েটারের মাধ্যমে মানুষকে উজ্জীবিত করতে চায়। মন’উকূলে” নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষের মানবিক বোধগুলোর প্রচ্ছন্ন ছবিগুলো কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বিগত দিনগুলোতে আমার রচনা ও নির্দেশনায় বেশি কয়েকটি তঞ্চঙ্গ্যা নাটক আমরা মঞ্চে উপস্থাপন করেছি। কিন্তু এইবার আমাদের “তৈনগাঙ থিয়েটার’ এর প্রথম প্রযোজনা ‘মন’উকূলে’ নাটকটির আমার গল্পে নাট্যরূপ ও নির্দেশনার দায়িত্বটি আমরা অর্পণ করেছি স্বনামধন্য নাট্যকার ও নির্দেশক আশিক সুমন-কে। যিনি জাতীয় পর্যায়ের গুণী ও সৃষ্টিশীল একজন নির্মাতা। কারণ আমরা চেয়েছি এই নাটকটির যেন পরিপূর্ণ গুণগত মান বজায় থাকে। সেই লক্ষেই আমরা এই নাটকটি মঞ্চে আনার চেষ্টা করেছি।”
‘মন’উকূলে’ নাটকটির নাট্যকার ও নির্দেশক আশিক সুমন বলেন, “ আমার নাট্যযাত্রায় আরও একটি নতুন পথ সৃষ্টি হলো। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা’র গল্পে ‘মন’উকূলে’ নাটকটি আমাদের মনুষ্যত্বের দুয়ারে আরও একটিবার কড়া নাড়বে বলে আমার বিশ্বাস। লোভ আর স্বার্থবাদিতা যেখানে প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে উদাত্ত মুক্তির আহ্বানে ডাকছে ‘মন’উকূলে’। স্বার্থান্বেষী মনের ওপারেই আছে নিঃস্বার্থ পথের দিশা। আর মুক্তি সেখানেই! নাটকটি তৈরি করতে সংলাপের পাশাপাশি অঙ্গভঙ্গি ও ভাবের আদান-প্রদানের উপর গুরুত্ব দিয়েছি। যেহেতু ‘মন’উকূলে’ একটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার নাটক সেহেতু এর উপস্থাপনে মানুষের চিরাচরিত ঢঙ রস ব্যবহার করে দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে যেন একটি বিশ্বস্ত সম্পর্ক স্থাপন হয় সেই চেষ্টা করেছি। আর থিয়েটারের তো একটি বিশ্বময় ভাষা রয়েছেই। একটি পুরাণিক পটভুমির আলোকে নাট্যঘটনাগুলোকে সম-সাময়িকের রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আবহসংগীত, মঞ্চ ও আলো প্রক্ষেপনে একটি বিমূর্ত ছবি আঁকা হয়েছে।”
নাটকটির মিডিয়া কনসালটেন্ট মনি পাহাড়ী বলেন, “অনেকদিনের স্বপ্ন প্রত্যেক জাতিসত্তার একটি করে থিয়েটার গড়ে তোলার। তবে নিজ নিজ কমিউনিটির আগ্রহ ছাড়া এটা সম্ভব নয়। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যার উন্মাদনা আমাদের সে স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার পূর্ণাঙ্গ মঞ্চনাটক আমরা উপস্থাপন করতে পেরেছি। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ। দলের পক্ষ থেকে আরও বেশ কয়েকটি শো এর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও নাট্যামোদী দর্শক ও পৃষ্ঠপোষকের উৎসাহে আমরা এই ‘মন’উকূলে’ নাটকটির প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত থাকব। তাছাড়া গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মিডিয়াতেও এই তঞ্চঙ্গ্যা নাট্যদল ও তাদের প্রথম প্রযোজনার খবরটি প্রচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ।”
‘মন’উকূলে’ নাাটকটিতে বিভিন্ন চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন- রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা. সুবিতা তঞ্চঙ্গ্যা, বিশ্বজিৎ তঞ্চঙ্গ্যা, প্রদীপ্ত তঞ্চঙ্গ্যা, বিশাল তঞ্চঙ্গ্যা ও গুরুজী- বিনয় কান্তি চাকমা, সুকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। আবহ সংগীত, মঞ্চ, আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন আশিক সুমন। পোশাক পরিকল্পনা ও প্রপস্-মন’উকূলে টিম। নাটকটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় অনুবাদ করেছে মন’উকূলে টিম। সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন জানন তঞ্চঙ্গ্যা, সার্বিক তত্ত্বাধানে এডঃ সুদ্বীপ তঞ্চঙ্গ্যা, এবং মিডিয়া কনসালটেন্ট- মনি পাহাড়ী।
হল ভর্তি দর্শক নাটকটি উপভোগ করেছে। নাটকটির ঘটনা ও অভিনেতার বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে দর্শক এর সাড়া ছিল অভূতপূর্ব। নাটকটিকে কেন্দ্র করে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি উৎসবের আমেজ লক্ষ্য করা গেছে। পুরো প্রযোজনাটির উপস্থাপনে মুগ্ধ হয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ‘তৈনগাঙ থিয়েটার’ কে আর্থিক অনুদানও ঘোষণা করেন। নতুন একটি নাট্যদলের আত্মপ্রকাশ স্বার্থক হয়েছে বলে নাট্যামোদী দর্শক তাদের অভিমত প্রকাশ করেন। ‘তৈনগাঙ থিয়েটার’ তাদের সৃষ্টিশীল কাজ দিয়ে আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।