সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘নিউজ ফিডে’ যা-ই দেখা যায় তা-ই সংবাদ নয়। কিন্তু অর্থ উপার্জনের নেশায় পড়ে অনেকে এখন যেনেতেনভাবে নানা তথ্য প্রচার করছেন ইন্টারনেটে। এর মধ্য দিয়ে প্রচারিত কোন তথ্য সঠিক, কোন তথ্য ভুয়া সেটি শনাক্ত করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে সচেতনতা তৈরি করা গেলে ভুল তথ্য ছাড়ানো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস (ক্যাম) অক্টোবরের আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘স্যোশাল মিডিয়ায় ভুয়া সংবাদ: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আয়োজন করে সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস বিষয়ক জাতীয় কমিটি-২০২১। মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সাইবার প্যারাডাইসের পৃষ্ঠপোষকতায় মাসব্যাপী সচেতনতামূলক এই কর্মসূচি চলছে। ২৪ অক্টোবর রাতে আয়োজিত ওয়েবিনার অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচার করে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন। ২০০৪ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এবং ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস পালন শুরু করে সিসিএ ফাউন্ডেশন।
ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন ক্যাম জাতীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর ফারুক খন্দকার। সঞ্চালক ছিলেন কমিটির সদস্য সচিব ও সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) উপদেষ্টা ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা ট্রিবিউনের সহযোগী সম্পাদক আবু সাঈদ আসিফুল ইসলাম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের মিডিয়া স্ট্যাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক ড. দীন এম সুমন রহমান।
সুমন রহমান বলেন, একদম মিথ্যা কিংবা অর্ধসত্য তথ্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো হয়। এটিই ভুয়া সংবাদ। মিসইনফরমেশন, ডিজইনফরমেশন ও ম্যালইনফরমেশন- তিন ধরনের তথ্য সমাজের জন্য ক্ষতিকর। নতুন আরেকটি শব্দ এসেছে মিডইনফরমেশন, অর্থাৎ কোনো তথ্য পুরোপুরি সঠিক কিংবা ভুল বলে সিদ্ধান্তে যেতে পারছে না, এমন তথ্য।
এছাড়া মিসইনফরমেশন মানে ভুল তথ্য। অজ্ঞতা বা অসতর্কতার কারণে এমন ভুল তথ্য ছড়ানো। ডিজইনফরমেশন হলো কোনো ব্যক্তি, সামাজিক গ্রুপ, সংগঠন বা দেশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য ভুল তথ্যের ইচ্ছাকৃত ব্যবহার করা। ম্যালইনফরমেশন হলো তথ্যটি সঠিক। কিন্তু সঠিক তথ্যকে কোনো ব্যক্তি, সামাজিক গ্রুপ, সংগঠন বা দেশের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার।
অধ্যাপক সুমন বলেন, কোনো তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ হলে সেই ওয়েবসাইট যদি কোনো প্রতিষ্ঠিত বা মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম হয় তাহলে সেটি সাধারণত ভুল তথ্য দেবে না। এছাড়াও যেকোনো ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেসবারে ওয়েব ঠিকানার শুরুতে https:// থাকলে সেটি নিরাপদ মনে করা যায়, আর শুধু http:// থাকলে সেই ওয়েবসাইট নিরাপদ না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনিটাইজেশন সিস্টেম অর্থাৎ স্যোশাল মিডিয়ায় তথ্য প্রচারের মাধ্যমে উপার্জন করার সুবিধার জন্য অনেকে বিভিন্ন নামে ওয়েবপোর্টাল পরিচালনা করছেন। এই প্রেক্ষাপটে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে এমন একটা ইনফরমেশন ইকোসিস্টেম গড়ে উঠুক, যেন ভুল তথ্য ছড়ানো বন্ধ করা যায়। একইসঙ্গে আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ডিজিটাল লিটারেসিও বাড়াতে হবে। কিছু স্যোশাল মিডিয়া ভুয়া তথ্য প্রচার ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু সব স্যোশাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষ এমন উদ্যোগ নিচ্ছে না।
আবু সাঈদ আসিফুল ইসলাম বলেন, ইন্টারনেটে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে মনিটাইজেশন পদ্ধতি। সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেতে এটি এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
সাংবাদিক আসিফুল ইসলাম বলেন, ইন্টারনেট এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। এটির অপব্যবহার করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যখন কোনো ভুল তথ্য ছড়িয়ে কেউ সমাজের ক্ষতির চেষ্টা করে তখন সেটি প্রতিরোধের জন্য একজন গণমাধ্যমকর্মী কিংবা গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
এই সিনিয়র সাংবাদিক মনে করেন, স্যোশাল মিডিয়ার নিউজ ফিডে যা আসে সেটিই কিন্তু ‘সংবাদ’ নয়। একজন গণমাধ্যমকর্মী যখন কোনো তথ্য পান তখন তার কর্তব্য অবশ্যই যেন তিনি তথ্যটি যাচাই করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করা। এর মাধ্যমে দর্শক/পাঠক সঠিক তথ্যটি পাবেন এবং এর মাধ্যমে সমাজ উপকৃত হবে।
ওমর ফারুক খন্দকার বলেন, ইন্টারনেটে ভুয়া তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে সচেতনতা খুব জরুরি। এছাড়া নিউজপোর্টালগুলোতে প্রত্যেকটি নিউজে পাঠকের রেটিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। তাহলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছাড়ানো তথ্য ঠেকাতে সচেতন পাঠকরা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবেন।