বুধবার, মে ৮Dedicate To Right News
Shadow

ভারত কেন চীনের বন্ধু আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে?

Spread the love
  • তারেক হোসাইন খান

ভারত আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে দলটি ভারতের `শত্রুরাষ্ট্র’ চীনের সহযোগী হওয়ার পরও। “শত্রুর শত্রু বন্ধু এবং শত্রুর বন্ধু শত্রু” কৌটিল্যের এই নীতি সর্বদা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রযোজ্য নয়।

যে কোন বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রধান রক্ষাকবচ চীন, ভারত নয়। ভারত চ‚ড়ান্তবিচারে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য কেননা ভারতের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এখন আর ৮০’র দশকের মতো চীনের সঙ্গে ম্যাচ করেনা। জন মিযারশাইমার-এর গ্রেট পাওয়ার ট্রাজেডি বা থুসিডাইডিসের পাওয়ার/ওয়ার ট্রাপ উভয়বিধ বিবেচনায় চীন-ভারত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে এবং থাকবে অপরের প্রভাবকে কমাতে/ধ্বংস করতে। এটি উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে বৃটেন-জার্মানীর দ্বন্দ্বকে মনে করিয়ে দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও নেপালে চীন এবং ভারতের পছন্দের দল ও নেতারা ভিন্ন। যেমন শ্রীলংকায় রাজাপাক্ষে সরকারকে ভারত অপছন্দ করে; তবে রাজাপরিবারটি চীনের প্রধান পছন্দ। নেপালে মাওবাদী প্রচন্ড (কোয়লিশন) সরকার ভারতের গুডবুকে নেই যেমনটা ঐতিহাসিকভাবে নেপালী কংগ্রেস ছিলো। এই দুইদল প্রশ্নে চীনের অবস্থান ঠিক বিপরীত। দক্ষিণ এশিয়ায়, সম্ভবত সারা বিশ্বে, ভারত এবং চীন একমাত্র শেখ হাসিনাকে সমর্থন করছে। কারণটা কি? কোন স্বর্থের টান এশিয়ার দুই পরাশক্তিকে একবিন্দুতে মিলিত করেছে?

চীন এই মুহুর্তে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে; তারমানে এই নয় বেইজিং খালেদা জিয়া বা বিএনপিকে অপছন্দ করে। চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌল স্তম্ভ হলো সরকারী দলের (বিদ্যমান সরকার) সঙ্গে সখ্যতা। সরকার পরিবর্তন ম্যালা ঝামেলার বিষয়, তারচেয়ে বরং ক্ষুদ্ররাষ্ট্রের নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত দুর্বল সরকারের পিছনে গ্রেটওয়ালের মতো দাঁড়ালে স্বার্থ অনেক সহজে রক্ষা করা যায়, আফ্রিকা এবং সেন্ট্রাল এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহ এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। চীন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে এর প্রধান কারণ মোটেই এই নয় যে রাষ্ট্রটি তার ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ এবং ব্যবসার নিরাপত্তা চায়; বরং সে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপোড়েনকে ব্যবহার করতে আগ্রহী। বেইজিং খুব ভালভাবে জানে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও এসবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হবেনা। জোট সরকারের সঙ্গে চীনের সখ্যতার গ্রাফগুলো এখনো জ্বল জ্বল করছে। মজার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি চীনের বিরোধীতা কখনো করেনা, তার যত ক্ষোভ ভারত নিয়ে। খালেদা জিয়া এবং তার সবর, নীরব এবং তথাকথিত নিরপেক্ষতার চাদর মুড়ানো সমর্থকেরা ভাসুরের নাম মুখে নিতে অনিচ্ছুক!

প্রশ্নটি আবারো চলে আসে, চীনের বন্ধু আওয়ামী লীগকে ভারত কেন সমর্থন করে? গত কয়েকদিন ভারতের কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং রাষ্ট্রদূতকে এই প্রশ্নটি আমি করেছি, আমার পিএচডি থিসিসের অংশ হিসেবে। প্রত্যেকের জবাব দশ ট্রাক অস্ত্র এবং তারেক রহমানের ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদদানে ঠেকেছে। ভেনিসের সব পথ যেমন পানিতে মেশে এবং বাংলাদেশে সবকিছু যেমন দুর্নীতিতে ঠেকে! সত্য-মিথ্যা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারতের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র (সম্ভবত রাজনীতিবিদরাও) বিশ্বাস করে খালেদা জিয়া সরকার ভারতের একটি শত্রু রাষ্ট্রের ইন্ধনে ভারতের ট্রাবলড পেরিফেরির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে বিশাল অস্ত্রচালন প্রেরণের পরিকল্পনাকারী ও অংশীদার ছিলো। তাদের মতে, ভারতের গোয়েন্দারা এটি জেনে যায় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সরসরি খালেদা জিয়াকে ’অনুরোধ’ করেছিলেন অস্ত্রের ডিপো ও ট্রাক জব্দ করতে। ভারতীয় উত্তরদাতারা শালীনতা রেখে বলেছেন বাজপায়ী `অনুরোধ’ করেছিলেন। তবে কল্পনা শক্তি প্রখর এমন কেউ ভিন্ন কিছু ভাবতে পারেন। লেভিয়াথানের ভাষা কেমন হয় লিলিপুটের সঙ্গে তা আমরা জানিনা। তবে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কিছুটা clue দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছে আফগান তালেবানদের ধ্বংস করতে একটি ঘাঁটি চেয়েছিলো, মোশররফ তা প্রত্যাখান করেন। এরপরই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেন, তবে প্রস্তুতি নাও বোমার আঘাতে পাথুরে যুগে ফিরে যেতে (“You should be prepared to be bombed back to the Stone Age. This was a shockingly barefaced threat, but it was obvious that the United States had decided to hit back, and hit back hard”, In the Line of Fire, p. 201)। বাজপায়ী বিচক্ষণ এবং মৃদুভাষী রাজনীতিবিদ। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস যদি এমনটি হয়ে থাকে, তবে তিনি অনুরোধই করেছিলেন এবং খালেদা জিয়া এই অনুরোধের হিডেন লাইন সার্থকভাবে পড়তে পেরেছিলেন।

আমার মনে দীর্ঘদিন ধরে একটা খচখচানি ছিলো, ৭ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার অস্ত্রচালান যার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ছিলো অতি ক্ষমতাধর কয়েকজন বিএনপিপন্থী উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তা, সেটিকে একজন নিরস্ত্র সার্জেন্ট আটকে দিলো!!! এটি কি আরেকটি জজমিয়া নাটক? আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হলো, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর এমন প্রবল প্রতাপশালী ইমেজ রয়েছে যে, উর্দিপরা জোয়ানদের সার্জেন্ট তো অনেকদূরের বিষয়, খোদ আইজিপি-ও ঘাটাবে না!

ভারতের রাষ্ট্র প্রশাসন বিশ্বাস করে শেখ হাছিনা সরকার কোন তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে বা অর্থের লোভে ভারতের ক্ষতি করতে বিক্রি হয়ে যাবেনা কিন্তু বিএনপি তা করতে আবারো আগ্রহী হবে। দলটির ইতিহাস এমনটা জানায়। পাকিস্তান মিজো ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাবর্ত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় দিয়েছিলো ১৯৬০ এর দশকে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর মিজো ও নাগাদের বিতাড়িত করেন। জেনারেল জিয়া আবার তাদের প্রশ্রয় দেন। খালেদা জিয়া সরকারও পরবর্তীতে একই নীতি অনুসরণ করেছে। শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমস্ত ক্যাম্প ধ্বংস করেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এসব বিষয় এমন যে তা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব, তবে তা ওপেন সিক্রেট।

বিএনপি ভারত প্রশ্নে এক জন্মগত মৃত্যু ফাঁদে পড়েছে। বাংলাদেশে বিএনপির জনসমর্থনের প্রধান কারণ ভারত ও হিন্দু বিরোধীতা, যা তার মুসলিম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিএনপির ভারত বিরোধীতা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আদায়ের মাপকাঠিতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ। এটি সত্য, বিএনপি পানি নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলো জাতিসংঘে কিন্তু একফোটা পানিও আনতে পারেনি এমনকি ভারতের বিরুদ্ধে দোস্ত মুসলিম কোন রাষ্ট্রের সমর্থনও পায়নি। বিএনপি জানে ভারতকে চাপে রেখে কোন কিছু তার নিকট থেকে আদায় করা সম্ভব নয়; তবে বিএনপি এটি করে ভারত বিরোধীতাকে কেন্দ্র করে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে। এখানেই বিএনপির মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে। রিজনাল হেজিমন সম্ভবত তার নিজের স্বার্থে তার সমস্ত স্টেট ম্যাকানিজম ব্যবহার করবে বিএনপির বিরুদ্ধে। মনে পড়ে গেল, চার্চিলের সেই বিখ্যাত ভাষণ। পার্লহারবারে জাপানের আক্রমণের (৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১) কারণে যখন যুক্তরাষ্ট্র তার সুদীর্ঘ আইসোলেশন নীতি ভঙ্গ করে জাপান এবং নাৎসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তখন চার্চিল বলেছিলেন, ‘রিয়েল হেজিমন’ এখন যুদ্ধের ময়দানে। নাৎসী ও নাকবুচা বেঁটেদের এখন রিয়েল মন্সটার হত্যা করবে। তিনি বলেছিলেন, আহা! প্রশান্তি ও নিরাপত্তাবোধ নিয়ে এক গভীর ঘুম দিলাম, ধন্যবাদ পার্লহারবার। ব্রিটিশদের আর সীবীচ, পাহাড়, জঙ্গলে নি:সঙ্গ যুদ্ধ করতে হবেনা; যুদ্ধ দেবতা স্বয়ং হাজির ময়দানে। বুঝমানের জন্য ইশারা যথেস্ট। তাই নয় কি?

যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের একমাত্র রিয়েল হেজিমন। অনেকের ধারণা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করবে। অবশ্যই সে ইচ্ছা করলে তা একদিনে করতে পারবে, শেখ হাসিনা অকপটে তা স্বীকার করেছেন। তবে আমার মনে হয়না মামুলি নিষেধাজ্ঞা অস্ত্র ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে খুব বেশি সক্রিয় ভুমিকা নেবে। ইরাক, সিরিয়ার মতো আমাদের তেল নাই; আমাদের রক্তের দামে বাহারি নামের মার্কিন ক্ষেপনাস্ত্রের দাম উঠবেনা। তাহলে বাকি থাকলো এক রিয়েল রিজনাল হেজিমন (ভারত)। বিএনপিকে নিয়ে ভারত সরাসরি নিরাপত্তা সংকটে ভুগছে। গত নির্বচনের আগেও ভারতের গোয়েন্দারা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলো তারেক রহমান এবং পাকিস্তানি আইএসআয়ের গোপন বৈঠক বিষয়ে। বিএনপি প্রশ্নে ভারতের নিশ্চুপ থাকার স্পেস খুব সংকীর্ণ। ২০১৫ সাল থেকে ভারতের নাগাল্যান্ড, আসাম এবং মিজোরামে রিলেটিভ পিস বিরাজ করছে: অন্তত সাউথ এশিয়ান টেররিস্ট পোর্টালের পরিসংখ্যান তা বলছে। সম্ভবত এর একটি বড় কারণ শেখ হাসিনা; কারণ তিনি ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরাপদ ট্রেনিং এবং অস্ত্রের রুট ধ্বংস করেছেন। অখন্ডতা ছোট-বড় সব রাষ্ট্রের কোরভ্যালু/ কেন্দ্রিয় বিষয় যার সঙ্গে কোন আপোষ চলেনা। এটি ভারতকে আওয়ামী লীগের দিকে অনিবার্যভাবে ঠেলে দিয়েছে।

 

লেখক: তারেক হোসাইন খান, সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইডডি গবেষক, দ্য এডুকেশন ইউনিভার্সিটি অব হংকং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *