ভোক্তা অধিকার আইন অনুসারে পণ্যেও মোড়কে উৎপাদনের তারিখ দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও সিগারেট কোম্পানীগুলো এই আইন মানছে না। তবে ৬১% ধোয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের (জর্দ্দা ও গুল) মোড়কে উৎপাদনের তারিখ পাওয়া গেছে। উৎপাদনের তারিখ না দেওয়ায় সিগারেট কোম্পানীগুলো কর ফাঁকির সুযোগ নিচ্ছে। নতুন কর ঘোষণার ৩ মাস পরও বৃহৎ দুইটি কোম্পানি পুরাতন দামে প্যাকেট বিক্রি করছে যা উৎপাদনের তারিখ না থাকায় ধরা যাচ্ছে না। পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান না করার সুযোগও নিচ্ছে তারা। আজ ২৬ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া হলে টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভির্সিটি ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট (বাটা)-এর আয়োজনে ‘তামাকজাত দ্রব্যের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন- বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা এসব দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী হোসেন আলী খোন্দকার। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আর্ন্তজাতিক সংস্থা ভাইটাল স্ট্রাটেজিস-এর কারিগরি পরামর্শক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন; ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর পরিচালক গাউস পিয়ারী মুক্তি, ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিটিস অব সোসাইটি (ডাস্) এর সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মোয়াজ্জেম হোসেন টিপু। অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের পক্ষে এইড ফাইন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)-এর সদস্য সচিব ও প্রকল্প পরিচালক এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক মো. বজলুর রহমান। গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)-এর সহকারী গবেষক ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজা। এছাড়া অনুষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের তামাক নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা।
মূল প্রবন্ধে ফারহানা জামান লিজা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতির মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান অন্যতম। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধনী ২০১৩) এর ধারা ১০ অনুযায়ী সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের উভয়পাশের মূল প্রদর্শনী তলের উপরিভাগের ৫০ শতাংশ এলাকা জুড়ে তামাকের স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পকিৃত সচিত্র সতকর্বার্তা প্রদান করতে হবে। টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গত ২০২৩ সালের মে মাস থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত দেশের ৮টি বিভাগের বিভাগীয় শহর হতে ২১৬টি তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।
টিসিআরসির গবেষণায় বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে, তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ৮৭% তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পাওয়া গেছে; ৭৯% মোড়কের উভয়পাশে এই সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হয়নি; ৬৭% মোড়কে পঞ্চাশ শতাংশ এলাকা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হয়েছে; ৫৭% মোড়কে ছবির সাথে লিখিত বার্তা প্রদান করেনি; ৫৭% মোড়কের লিখিত সতর্কবাণী কালো জমিনে সাদা অক্ষরে মুদ্রিত হয়েছে। সকল বিড়ির মোড়কই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যান্ডরোল দিয়ে ঢেকে থাকতে দেখা গেছে; এবং ৩৫% মোড়কে “শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য অনুমোদিত” মর্মে কোন বাণী প্রদান করা হয়েছে; কোনো সিগারেটের কার্টনেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পাওয়া যায়নি। এছাড়া ৩৮% মোড়কে ভ্যাট রেজিস্টেশন নাম্বার পাওয়া গেছে; ৩৪% মোড়কে ট্রেড লাইসেন্স নাম্বার ছিল; ৬১% মোড়কে উৎপাদনের তারিখ ছিল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, সমস্যা উদ্ঘাটন ও সমাধানের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত নিতে হলে গবেষণা করতে হবে। আজকের এ গবেষণার ফল সরকারকে তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। তরুণ প্রজন্মকে এ ধরনের গবেষণায় এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের জীবনেও প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তরুণ প্রজন্ম যাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে না পড়েন সেজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে শাগুফতা সুলতানা বলেন, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা, স্থানীয় সরকার কর্তৃক লাইসেন্স প্রদান তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তামাক নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের গবেষণা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আশা করছি ২০৪০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করা সম্ভব বলে আশা করছি।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, সিগারেট কোম্পানীগুলো প্রতিনিয়ত আইন লঙ্ঘন করছে। তারা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গ করছে। প্যাকেজিং আইন লঙ্ঘন করছে। সবাইকে আইনের উপর শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিৎ। জনগণেরও অনেক দায়িত্ব থাকে। তামাক নিয়ন্ত্রণসহ যেকোনো ধরনের সমস্যা বা অভিযোগ থাকলে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বরাবর অভিযোগ জানাতে হবে। সে অনুযায়ী দায়িত্বশীলরা যথাযথ পদক্ষেপ নিবে। কারণ সরকার জনস্বাস্থ্য ও তামাক নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট আন্তরিক।
গাউস পিয়ারী মুক্তি বলেন, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার। সুতরাং এই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সঠিক বাস্তবায়নে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদেরকেও তামাক নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে এবং ভূমিকা রাখতে হবে।
মোয়াজ্জেম হোসেন টিপু বলেন, ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার বাংলাদেশের কালচারের সাথে মিশে আছে। এর ব্যবহার কমাতে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে মোড়কে এই সতর্কবাণীর পরিমাণ ৫০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৯০ শতাংশ করা অত্যন্ত জরুরি।