
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ “সাম্যবাদী” প্রকাশের শতবর্ষ পূর্তিতে বিশেষ সংকলন গ্রন্থ “গাহি সাম্যের গান” প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইকরাম আহমেদ লেনিন এবং প্রকাশ করেছে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন।
গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে আজ শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আইয়ের মুস্তাফা মনোয়ার স্টুডিওতে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নজরুল সংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরা, নজরুল গবেষক সাজেদ কামাল, কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এএফএম হায়াতুল্লাহ, বইটির সম্পাদক ইকরাম আহমেদ লেনিন, দেশবরেণ্য নজরুল সঙ্গীত শিল্প ফেরদৌস আরা এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু-সহ দেশের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, নজরুল গবেষক, সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষাবিদরা।
বৈষম্যহীন বিশ্বমানবতার বার্তা দেয়া নজরুলের অমর কবিতাগুলো বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরতে এই গ্রন্থে নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ১১টি কবিতা ১১টি আন্তর্জাতিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। পাশাপাশি, বইটিতে নজরুলের সাম্যবাদ ও সাহিত্যচিন্তা নিয়ে নজরুল গবেষক ও লেখকদের ১০টি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। ২০২৫ সালে তার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সংকলন ‘গাহি সাম্যের গান’ নজরুলকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে পরিচিত করাবে বলে প্রকাশনা উৎসবের অতিথিরা আশা প্রকাশ করেছেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ মানবতার মুক্তি ও সাম্যের অনবদ্য ঘোষণা। শতবর্ষ পর আজও এ কাব্যগ্রন্থ সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁরা আরও উল্লেখ করেন, নতুন প্রজন্ম ও বিশ্বমঞ্চে নজরুলকে পৌঁছে দিতে এ ধরনের বহুভাষিক উদ্যোগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
‘গাহি সাম্যের গান’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে নজরুলের অমর কবিতা ‘নারী’ আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী টিটো মুন্সী। কণ্ঠের ওঠানামা, সঙ্গে স্বভাবসুলভ অঙ্গভঙ্গিতে করা আবৃত্তি দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের কিছুক্ষণের জন্য নজরুলের অন্তরটাকেই যেন আরও ভালোভাবে বুঝতে দিলেন এই আবৃত্তিশিল্পী।
টিটো মুন্সীর আগে কাজী নজরুলের সাম্যের বাণী তুলে ধরা মানুষ কবিতাটি আবৃত্তি করেন লেখক ও আবৃত্তিশিল্পী শিমুল পারভীন।
এরপর অতিথিরা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গাহি সাম্যের গান’ গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন।
গ্রন্থটির প্রকাশক এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু বলেন,“জাতীয় কবির সাম্যের বাণী শুধু বাংলা সাহিত্যের সম্পদ নয়, এটি বৈশ্বিক মানবতারও সম্পদ। আমরা চাই, নজরুলের কাব্য ও দর্শন বিশ্বের সব মানুষের কাছে পৌঁছে যাক। গাহি সাম্যের গান সেই প্রয়াসেরই অংশ। আশা করি শতবর্ষ পূর্তিতে প্রকাশিত এই সংকলন নতুন প্রজন্মকে নজরুল চেতনায় সমৃদ্ধ করবে।”
গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছেন ইকরাম আহমেদ লেনিন। এই গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের মতো কোনো কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে আর নাই। সব ধরনের মানবিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই ১১ টি কবিতা যেন ১১টি পারমাণবিক বোমা! সামাজিক-মানবিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে এসব কবিতা যেন কঠোর আঘাত। আজও এমন বৈষম্য সমাজে-রাষ্ট্রে আছে, তাই নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ এখনো ১০০ বছর আগের মতোই প্রাসঙ্গিক।’
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থকে আকর ধরে ‘গাহি সাম্যের গান’ গ্রন্থের বিশিষ্ট দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১১ টি কবিতা ১১ টি ভাষায় এই বইতে আছে। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান,রুশ, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি এবং চীনা, কোরিয়ান, জাপানিজ ভাষায় অনূদিত হয়েছে সাম্যবাদীর কালোত্তীর্ণ ১১টি কবিতা। এছাড়া এই গ্রন্থে আছে সাম্যবাদী নিয়ে লেখা অসাধারণ ১০টি প্রবন্ধ।’
গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব আলোকিত করেছেন গানে গানে শ্রোতার প্রাণে নজরুলকে জাগ্রত রাখা শিল্পী ফেরদৌস আরা। তিনি নিজের ব্যক্তিজীবনে নজরুলের সাম্যবাদ চর্চার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সাম্যের পথপ্রদর্শক কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালি বৈষম্যের শিকার হয়েছে বলে নজরুলের দৃপ্ত ভূমিকা অর্থাৎ তাঁর কবিতা-গানের কারণে তাকে আরও বেশি আপন করে নিয়েছে, ভালোবেসেছে, তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে এতগুলো গান, এত কথা, এত লেখা, এত কবিতা, সব নজরুলের।’
নজরুলের সাম্যবাদকে নতুন করে সামনে আনার উদ্যোগের প্রশংসা করে এই শিল্পী বলেন, ‘নজরুলের সাম্যবাদ নিয়ে লিখে-বলে শেষ করায় উপায় নেই। তবু এই বইয়ের মধ্যে যতখানি এসেছে, এর জন্য সম্পাদক ইকরাম আহমেদকে আন্তরিক ধন্যবাদ। কোথাও কোনো লাভ নেই, আশ্বাস নেই, অর্থনৈতিক সহায়তা নেই তবু মুকিত মজুমদার বাবু নজরুলকে নিয়ে কাজ করে চলেছেন, এই নিয়ে ৩টি গ্রন্থ প্রকাশ করলেন। আমাদের আশা এমন কাজ অব্যাহত থাকবে।’
অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ, পরিবেশবিদ এবং নজরুল গবেষক সাজেদ কামাল বলেন, ‘নজরুল গুটিকয়েক মানুষের জন্য লিখেননি, তিনি চেয়েছেন তার সাম্যের কথা ছড়িয়ে যাক। একটা কাব্যগ্রন্থে ১১টি কবিতায় কবি নজরুল ধর্মের সাম্য, নারী-পুরুষের সাম্য, ধনী-গরিবের সাম্য, পরিবেশ… সব সাম্যের কথা আছে। এমন কাব্যগ্রন্থের নিদর্শন পৃথিবীতে অন্য সাহিত্যে বিরল। সাম্যের বাণীতে নজরুল বিশ্বজনীন। যতদিন মানুষ থাকবে, নজরুল মানবতার কথাই বলবে।’
কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও নজরুল গবেষক এএফএম হায়াতুল্লাহ বলেন, ‘নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থে যে ভাবধারা তা না সোশালিজম, না কমিউনিজম, আসলে হিউম্যানিজম (মানবতাবাদ)।’
উৎকৃষ্ট অনুবাদ এবং সুগভীর প্রবন্ধ সম্বলিত ‘গাহি সাম্যের গান’ গ্রন্থটির মূল্য ধরা হয়েছে ১২০০ টাকা। গ্রন্থটি পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার তেজগাঁও-তে প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনে। চাইলে পাঠানো যাবে ডাকযোগে ও কুরিয়ারে।
